বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অবঃ) তৌফিকুর রহমান

৭ই মার্চে যেহেতু আমার বাসা কাছেই ছিল আমি বাঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে যাই। ভাষণ শুনে বুঝতে পারি যে আমরা দিন দিন একটি স্বাধীন দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি অথবা খুব একটা খারাপ সময় অতিক্রম করবো বলে বুঝতে পারি।

২৫ শে মার্চ রাতে আমরা যথারীতি বাসায় ঘুমাতে যাই চারিদিকে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল জায়গায় জায়গায় গাছ কেটে বড় বড় পাথর দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

আমাদের বাসাটা ছিল বেশ পুরনো একটা বিল্ডিং। রাতে ভিতরের দিকের একটা রুমে আমরা ঘুমাতে যাই। সকালবেলায় আমার মা আমাকে বললেন তুমি যাও একটু রুটি নিয়ে আসো কিন্তু সাবধানে যেও কারণ রাতে বাইরে অনেক গোলাগুলি হয়েছিল।

আমি রশিদ বিল্ডিংয়ের কলাপ্সিবল গেটের কাছে এসে বাইরে তাকিয়ে দেখি এমন একটা দৃশ্য যা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। এমন একটা পরিস্থিতি মনে হচ্ছে যেন বাইরে একটা পাখিও নেই।

কি হয়ে গেছে গত রাতে তা বোঝা যাচ্ছিল না। অটোরিকশা নেই কোন লোকজন দেখা যাচ্ছিলোনা। চতুর্দিকে একেবারে খালি। আমাদের বিল্ডিংটা যেহেতু চানখারপুলের মোড়ে, ঐ জায়গাটায় সবসময়ই রিকশা থাকতো।

সেখানে একটা রিকশা ও ছিলনা এমনকি মনে হচ্ছিল যেন একটা পাখিও নেই, পশুপাখিও ভয় পেয়ে গিয়েছে হয়তো এমন কিছু রাতের বেলা ঘটেছিল।

যাইহোক আমি দু-একটা স্টেপ সামনে এগিয়ে রাস্তায় নামার সাথে সাথেই দেখতে পেলাম বিকট আওয়াজে হঠাৎ করে এলএমজি বন্দুক দিয়ে ফায়ার করতে করতে পাকিস্তানি সেনারা আসছে কার্জন হলের ঐদিকথেকে।

সত্যকথা বলতে ওই দিনগুলোতে আমরা যে মারামারি গুলো দেখেছি তা হতে পারে কেউ একজন অপরজনকে একটা চড় দিচ্ছে অথবা একটা ঘুসি দিচ্ছে কিন্তু বন্দুকের গুলির আওয়াজ আমরা কখনো শুনিনি তার উপরে হলো এলএমজি এবং এটা একদম থ্রিটনের উপরে প্লেস করে ফায়ার করতে করতে আসছে।

যেদিকেই ওরা মানুষজন দেখতে পাচ্ছে সে দিকে ওরা ফায়ার করতেছে। তা ছাড়া ব্ল্যাংক ফায়ার করেও আসতেছে।

এই ফায়ারিং এর আওয়াজ শুনে আমার পায়ে তখন সেন্ডেল ছিল এবং পরনে ছিল হাফপ্যান্ট, স্যান্ডেল ফেলে বাসার সামনের দিক থেকে না ফিরে এসে পিছনের দিকে গিয়েছিলাম, সেদিকে এই দৃশ্য দেখে পেছনের দিকে একটা ওয়াল ছিল সেই ওয়াল টপকে ঘরে ঢুকি।

ভয়ে কাঁপতে থাকি। ওরা গুলি চালাচ্ছিল যে কোন দিকে তা বুঝতে পারছিলাম না আর সেই গুলির আওয়াজ যে এতো ভয়ংকর আতংক সৃষ্টি করতে পারে তা আমার জানা ছিল না।

যে মানুষ এলএমজি গুলির শব্দ কাছে থেকে শুনেছে সেই বুঝতে পারবে যে এই গুলির আওয়াজটা কত ভয়ঙ্কর। আমি বাসায় ঢোকার পরপরই আমার মা ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিলেন।

ওরা চানখারপুলের মোড় থেকে গুলি করতে করতে ওই দিক দিয়ে চলে গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশ দিয়ে শহীদ মিনারের দিকে।

আমার কাছে জিনিসটা খুব অদ্ভুত মনে হল যে এরা সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই গুলি করছে, আবার অনবরত গুলি করে যাচ্ছে। তো এরা আসলে মানুষের মনে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। তো গাড়িটা কিন্তু ফায়ারিং করতে করতে চলে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরে যখন গোলাগুলি থেমে গেল আমি আবার ঘরের থেকে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু আমার মা আমাকে নিষেধ করলেন যে না, তুমি আর এই গোলাগুলির মধ্যে বাইরে যেও না।

খানিক পরে আমার মা যখন অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন তখন আমি আস্তে করে চুপিচুপি দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম। বেরিয়ে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশ দিয়ে ওখানে অনেক বড় বড় গাছ ছিল,

এই গাছগুলোর ভেতর দিয়ে মেইন রোডে না গিয়ে, যেহেতু আমি এলাকার ছেলে ছিলাম আমি ওখানকার সব রাস্তা চিনতাম, মেডিকেল কলেজের ভেতর দিয়ে আমি শহীদ মিনারের দিকে গেলাম।

আমি শহীদ মিনারের পিছন দিকে গাছের আড়ালে থেকে দেখলাম যে রাতে হয়তো কোনো শেল বা কোনো শক্তিশালী অস্ত্র দিয়ে শহীদ মিনারকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারেনি বাট পার্শিয়াল ড্যামেজ করেছে।

ওখানে কিছু বড় বড় গোলার আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ওটা দেখে আমি আস্তে আস্তে উনিভার্সিটির দিকে যেতে থাকলাম। বাঁ দিক দিয়ে যেতে যেতে আমি জগন্নাথ হলের সামনে গেলাম।

সেখানে গিয়ে দেখি চারিদিকে ছাত্রদের লাশ পড়ে রয়েছে। একেক জন একেক ভাবে পড়ে রয়েছে। কেউ সিঁড়ি থেকে নামার সময় পড়ে গিয়েছে, কারো বুকে গুলি আবার কারো মুখে হয়তো বেয়োনেট চার্জ করেছে,

কারো পেটে বেওনেট চার্জ করেছে কিন্তু একটা জিনিস যে সবাই মৃত। চারিদিকে শুধু রক্ত আর রক্তের গন্ধ। আমি বাঁ দিক থেকে গিয়ে গেটের কাছে যাওয়ার সাথে সাথে তীব্র রক্তের গন্ধে আমার বমি আসতে শুরু করল।

তখন আমার ভিতর অত্যন্ত ভয় কাজ করতে লাগল যে কি অবস্থা ! ছেলেগুলো কে মেরে ফেলে রেখে গেছে, লাশগুলোকে কেউ নেওয়ার মতো নাই দেখার মত নাই। বিক্ষিপ্তভাবে পড়েছিল লাশগুলো।

কারো হয়তো মাথা নিচে পা সিঁড়ির উপরে ওইভাবে পড়েছিল। আমি এগুলো দেখে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের ট্র্যাক দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে চানখারপুলে এসে আমার বাসায় ঢুকে পড়লাম।

আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খেতে লাগল যে, যে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে দেশের জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়া, সেই সেনাবাহিনী নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করে যাচ্ছে।

একজনের পর একজন মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে, এটা কি ধরনের সেনাবাহিনী? আমরা কি এদেশের নাগরিক না? আমি তখন ছোট, মাত্র ক্লাস টেনের ছাত্র এত কিছু বুঝিনা কিন্তু এই জিনিসগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।

এই যে ছেলেগুলো মারা গেল এদের বাপ মা কোথায়? এদের ডেডবডি গুলোকে কে নিয়ে যাবে? আর এর আগে আমি কখনও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কোন ডেডবডি দেখিনি।

তাই আমি বাসায় চলে আসার পরও রক্তের গন্ধগুলো তখনো আমার নাকে টের পাচ্ছিলাম। সেই গন্ধের অনুভূতি আমাকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি। সারা রাত বিছানায় ছটফট করেছি ঘুমানোর জন্য,

শুই আবার লাফ দিয়ে উঠি আবার শুই আবার লাফ দিয়ে উঠি, প্রচন্ড আতঙ্কে ভয়ে ঘুমাতে পারলাম না। এটাই ওরা চাচ্ছিল মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করো এবং হত্যা কর, মেরে ফেলো বাঙালিদেরকে।

সেদিন সন্ধ্যার সময় আরেকটা ঘটনা ঘটলো, আমাদের ওখানে যে রেল লাইন ছিল সেই রেল লাইনের দুই পাশে বস্তি ছিল, ওরা সেখানে এসে কি যেন ছুড়ে মারল তাতে ওই বস্তিতে আগুন ধরে গেল।

আগুন লাগার পরে লোকজন যখন পালানোর জন্য ছুটোছুটি করতে লাগলো তখন আবার পাকিস্তান আর্মি নির্বিচারে গুলি করে ওদের উপরে।

আমি বাইরে গিয়ে এই দৃশ্যটা দেখতে পারিনি কিন্তু সন্ধ্যার পরে টের পেয়েছি যে অনেক লোক কান্নাকাটি করতেছে। ছেলে-মেয়ে, ছোট বাচ্চা, বৃদ্ধ সবাই কান্নাকাটি করতেছে। আর্মিদের সেদিকে কোন খেয়াল নেই।

তো এই জিনিসগুলো আমাকে প্রচন্ডভাবে কষ্ট দিতে থাকে। মানুষ মানুষকে মারছে, মুসলমান মুসলমানকে মারছে। নিজ দেশের সেনা বাহিনীর লোকজন আমাদেরকে হত্যা করছে।

পরের দুই দিন আমাকে বাসা থেকে বের হতে দেয়নি। ২৭ কি ২৮ তারিখের দিকে কারফিউ উঠে গেল। আমাদের উপর তালায় আমার দুটো সমবয়সী বন্ধু ছিল।

একজনের নাম কামাল, ওর গ্রামের বাড়ি বরিশালে, আরেকজনের নাম বিল্লাল, ওর গ্রামের বাড়ি ছিল সিলেট। আমরা তিনজনে মিলে ওখানে বসি। আমার আব্বার একটা ট্রানজিস্টার ছিল।

ওটা নিয়ে আমাদের বাসার ছাদে আমরা বসি যদিও বিল্ডিংটা অনেক পুরনো ছিল এবং খুবই ভগ্নদশায় ছিল । তো ওখানে ছাদে একটা দেয়াল ছিল যেখানে বসলে বাহির থেকে আমাদেরকে দেখা যেত না।

আমি বসে বসে আমার দুই বন্ধুকে বলছিলাম যে, কামাল কি হচ্ছে এগুলো? বিলাল কি হচ্ছে এগুলো? আমরা কি কুকুরের থেকেও অধম নাকি?

কুকুর দেখো ঠিকই রাস্তায় স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু আমাদের দেখো, আমাদের কোনো নিশ্চয়তা নেই।

আমাদের যারা রক্ষা করবে, যাদের বেতন আমাদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে হয়ে থাকে, সেই আর্মি আমাদেরকে মারছে ! কোন আর্মি যদি কোনো সাধারণ মানুষকে হত্যা করে, তাহলে সেই আর্মির তো বিচার হয়, আর এদেরকে দেখে মনে হচ্ছে সাধারণ লোকদেরকে হত্যা করার জন্য এদেরকে আরো পুরস্কার দেয়া হচ্ছে ।

যাহোক, তারপরদিন বাজার করার জন্য একটু কারফিউ শিথিল করা হলো। আমরা সেই সুযোগে ঘর থেকে একটু বের হলাম এবং তারা আমাদেরকে খুব ভালো করে চেক করছিল। নানারকমভাবে আমাদেরকে হেরেজমেন্ট করছিল। মানে আমাদেরকে নিয়ে তামাশা করার মত অবস্থা ।

২৬ কি ২৭ তারিখের দিকে আমরা বাংলাদেশ বেতারটা শুনলাম। তো খুব লোফ্রিকোয়েন্সিতে শুনতে পাচ্ছিলাম। অনেকসময় কানেকশন কেটে যাচ্ছিল। ওখানে শুনলাম যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এবং সবাইকে অস্ত্র হাতে নিতে বলা হয়েছে।

যুদ্ধ করতে বলা হয়েছে, প্রতিরোধ করতে বলা হয়েছে। যে ব্যাপারটাতে আমরা একেবারে কনভিন্সড ছিলাম যে এ ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই ।

তো আমরা ভাবছিলাম যে যুদ্ধে কিভাবে যাব? আমরা ঢাকার ছেলে পেলে ছিলাম। ঢাকার বাহিরে খুব একটা যাইনি। পথ ঘাট চিনিনা, কোথায় যেতে হবে তাও জানিনা।

কোথায় ট্রেনিং হবে? রাস্তা না চিনলে তো আর যাওয়া সম্ভব না। তো আমরা খোঁজখবর লাগাই। আমার এক বন্ধু ছিল। ও পল্টনে থাকতো। ওর নাম ছিল নাজমুল।

ওর দোকানে গিয়ে প্রায়ই আমরা বন্ধুবান্ধবরা গল্প করতাম। তো ওখানে গিয়ে আমি আমার বন্ধু নাজমুলকে বললাম, নাজমুল তুই খবর নে কে রাস্তা জানে। কোথায় ট্রেনিং দেয়। আমরা তো রেডিওতে শুনেছি যে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করছে। প্রশিক্ষণ ছাড়া বা অস্ত্র ছাড়া কিভাবে যুদ্ধ করবে? এর পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। তো একদিন খবর পেলাম যে একজন ঘুরে আসছে ওদিক থেকে যেখানে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

তো আমরা তার সাথে দেখা করার জন্য একজনকে বললাম। আমাদেরকে নিয়ে গেল পল্টনে শহীদ রেজাউল করিম মানিক বীরপ্রতীক, উনার বাসায়।

মানিক ভাইয়ের বাসায় গেলাম, তিনি আমাদেরকে বললেন, তোমাদের বয়স তো অল্প, যুদ্ধে তো অনেক পরিশ্রম করতে হবে, অনেক কষ্ট করতে হবে। উনি ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

যাইহোক, উনি আমাদের বললেন যে, সব থেকে কাছের ক্যাম্প হবে আগরতলার দিকে। আরো বললেন যে, তোমরা নবীনগর পর্যন্ত বাসে যেতে পারবে।

এরপরে নৌকায় করে নদী পার হয়ে বাকিটা পথ তোমাদের হেটেই যেতে হবে। তোমরা যাওয়ার সময় যত হালকা যেতে পারো, তত ভালো। সম্ভব হলে সাথে টাকা নিয়ে যেও কারণ খাওয়া দাওয়ার জন্য টাকা লাগবে।

ওখানে পৌঁছে তোমরা সিপিএম অফিসে যেও। সিপিএম অফিসে যাওয়ার পরে ওরা তোমাদেরকে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিবে। তো আমরা ১৪ই জুন বাসা থেকে পালাই।

আমাদের অন্যান্য সদস্যরাও একই সময়ে বাসা থেকে বের হয়। আমরা যা কিছু নিতে চেয়েছিলাম তা আগেই বাসা থেকে বাইরে বের করে রেখেছিলাম ।

তো আমাদের ছয়জনের যাওয়ার কথা ছিল সেই ছয়জনের মধ্যে থেকে চারজন বাসা থেকে পালাতে পেরেছিলাম বাকি দু'জন বাসা থেকে পালাতে পারেনি।

পালানোর সময় ধরা পড়ে গেছে ওরা। আমরা সকাল আটটার মধ্যেই নবীনগর পৌঁছে যাই। নবীনগর পার হয়ে হাটা শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে রাতটা এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নেই।

সেই কৃষক তার ছোট্ট একটা ঘর, সেখানে আমাদের থাকতে দেয়, আমাদের খুব যত্ন করে। তার ছোট্ট একটা বাচ্চাকে নিয়ে সে ঘরের বাইরে থাকে আর আমাদেরকে ঘরের মধ্যে থাকতে দেয়।

সে গরিব মানুষ ছিল, তার খাওয়ানোর মতো সামর্থ্য ছিল না, তারপরও সে একটা মুরগি জবাই করে রান্না করে এবং ভাত রান্না করে আমাদের খেতে দেয়।

আর সে খাবার খেতে এত স্বাদ, এত ভালো লাগলো। আর এই স্তরের লোকজনদের যে অবদান, সেই অবদান আমরা কখনো ভুলতে পারবো না। বিশেষ করে এই যে কৃষক, তার কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না।

পরের দিন আমরা হাঁটা শুরু করলাম। পথে জায়গায় জায়গায় আমাদের গ্রামের লোকজন সহযোগিতা করেছে। পথের সবচেয়ে মারাত্মক যে জায়গাটা, সেটা হচ্ছে সিএন্ডবি রোড, বর্তমানে যেটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রোড, সেটা পার হওয়া সবচেয়ে কষ্টকর ছিল।

এই রাস্তাটা পাকিস্তান আর্মি সবসময় টহল দিত আর ওদের টহলের মধ্যে কেউ পড়ে গেলে তো নির্ঘাত মৃত্যু। তো গ্রামবাসী আমাদেরকে সহযোগিতা করল।

তারা আমাদেরকে উপদেশ দিল যে, দিনের বেলা এই রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করো না তাহলে ধরা পড়ে যাবা। রাতে সন্ধার পরে তোমরা এই রাস্তাটা পার হবা,

আর তোমরা চেষ্টা করবা যে মাগরিবের আযানের পরপরই ওই জায়গাটা পার হবার, কারণ তোমাদের ঐ জায়গাটা পার হবার পরে ওদিকে অনেকখানি পথ হাঁটতে হবে। আমরা অলরেডি দুইদিন হেঁটেছি।

যখন আমরা সিএনবি রোডের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম, সেখানে রাজাকার টাইপের একটা গ্রুপের সাথে দেখা হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করে বসলো কোথায় যাচ্ছেন? কেন যাচ্ছেন? এদিকে আমি যাচ্ছি, সামনে আমার বাড়ি, কোথায় বাড়ি? এ ধরনের প্রশ্ন করল।

আমাদের সঙ্গে ছিল কামাল, সে ছিল বরিশালের এবং তার স্বাস্থ্য অনেক ভালো, বয়সে সে আমার থেকে একটু বেশি ছিল এবং সে খুব রাগী ছিল। আর তার সাথে একটা ছোট ছুরি ছিল।

তো সেই কামাল চাকু বের করে সেই রাজাকার টাইপের লোকটাকে মারতে উদ্যত হল। আমরা চারজন ছিলাম, বাকি তিনজন ওকে আটকানোর চেষ্টা করলাম আর গ্রামবাসীরা সবাই আমাদের পক্ষেই ছিল, আর সেই রাজাকার টাইপের লোকটা যখন বুঝতে পারলো যে সে আমাদের সাথে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না।

ওরা দু'চারজন ছিল কিন্তু ওরা বুঝতে পারল যে আমাদের সাথে গ্রামবাসীরা থাকার কারণে ওরা খুব একটা সুবিধা করতে পারবেনা। অবস্থা বেগতিক দেখে ওরা চলে গেল।

এই একটা প্রথম বাধায় আমরা পড়লাম। আরেকটা বাধায় পড়লাম যখন আমরা ঠিক সিএনবি রোডে উঠবো, সেখানে পাশে একটা জায়গায় আমরা বসে ছিলাম। অপেক্ষায় ছিলাম অন্ধকার হবার।

যখন একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল, অন্ধকারটা এমন যে ২০০-৩০০ গজ দূরে থেকে বুঝা যায় না যে এখানে কি হচ্ছে। সেরকম অন্ধকার হবার পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে এখন যাওয়া যায়।

গ্রামটা পার হয়েই দেখি একটু ছোট্ট পানির মত জায়গা ছিল। সেই পানি টুকু পার হতে গিয়ে আমরা গলা পানির মধ্যে পড়ে গেলাম। তারপর সেখান থেকে উঠে রাস্তাটা পার হলাম।

তো রাস্তা পার হবার জন্য যখন আমরা রাস্তাটায় উঠলাম, তখন ৩০০ কি ৪০০ গজ দূরে আর্মিদের তিনটা গাড়ি পার্ক করা ছিল। তারা খুব সম্ভবত কোন আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল।

তো সেই তিনটা গাড়িই একসাথে হেডলাইট জ্বালিয়ে দিল। আমরা ধরে নিলাম যে ৩০০ গজ দূরে থেকে হেডলাইট জ্বালিয়ে দিলেও তেমন কিছু দেখা যাবে না।

খুব ঝাপসা হয়তো দেখা যেতে পারে, বাট পরিষ্কারভাবে দেখা যাওয়ার কথা না। কিন্তু ওরা গাড়ি থেকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করলো। আমরা রাস্তা পার হয়েই একটা ধান ক্ষেতের মধ্যে পড়ে গেলাম।

সেই ধানক্ষেতে কাদামাটি ছিল। সেই কাদা মাটির মধ্যে দিয়ে দৌড়ানো যে কতটা কঠিন ছিল তা বুঝানো সম্ভব নয়। আমরা সেই কাদা মাটির উপর থেকেই দৌড়ানো শুরু করলাম।

আমাদের মাঝে একজনের চোখে চশমা ছিল। তার সেই চশমা চোখ থেকে খুলে পড়ে গেল। চশমা তুলতে হবে কারণ চশমা ছাড়া সে দেখতেই পাবে না। আমরা সেই অন্ধকারের মাঝে কাদার মধ্যে চশমা খুঁজে পেলাম।

এর মধ্যে ওরা ফায়ারিং করতেছে। ওরা হয়তো না দেখেই ভয় দেখানোর জন্য ফায়ারিং করছে। আমরা সেই কাদার মধ্যে থেকে ভয়, আতঙ্ক নিয়ে ছুটছি।

কোন কিছুই জানিনা শুধু দৌড়াচ্ছি। আর আমাদের সাথে কোন ব্যাগ ছিল না। দুটো কাপড়ের গাইট ছিল।

আমার আর আমার বন্ধুর একটা গাইট আর বাকি দুইজন বন্ধুর আরেকটা গাইট ছিল। কিছুক্ষণ পরপর গাইট অদল বদল করে নিতাম। ওই কাপড়ের গাইট কাঁধে নিয়ে দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছিল।

দৌড়াতে দৌড়াতে একটা পুকুরের পাড়ে উঠলাম। আমরা প্রায় ৪০০ গজ দূরে ছিলাম। সেই ৪০০ গজ আমাদের কাছে মনে হচ্ছিল দশমাইল দৌড়াচ্ছি।

যাহোক, যখন একটা পুকুরের পাড়ে উঠলাম, পার ধরেই আমরা দৌড়াতে লাগলাম। ইচ্ছে ছিল যে পুকুরের ওপারে গিয়ে আমরা বিশ্রাম নেব, কিন্তু পুকুরের পাড়ে একদিকে কাটা দেওয়া ছিল।

তো আমরা দৌড়াতে গিয়ে সে কাটার মধ্যেই পড়ে যাই। আমাদের মনে হচ্ছিল যেন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছি। সেখানে অনেকক্ষণ পড়েছিলাম আমরা।

যখন আমাদের হুঁশ আসলো, আমরা কিছু আওয়াজ শুনতে পেলাম অর্থাৎ সেই আওয়াজেই হয়তো আমাদের চোখ খুলেছিলো। শুনতে পেলাম কিছু লোকজন ফিসফিস করে কথাবার্তা বলছে।

তো আমাদের মনে হলো যে তারা নিরাপদ। ভয়ের কোন কারণ নেই। তখন আমরা চারজন চারজনকে জড়িয়ে ধরে জয় বাংলা বলে চিৎকার করি।

মনে হচ্ছিল যেন আমাদের এই কণ্ঠস্বর অনেক দিন ধরেই কেউ চেপে ধরেছিল। তারপর আমরা উঠে ঐ পাড়ে গিয়ে দেখলাম যে অনেকগুলো পরিবার।

শরণার্থীদের ঢল। এদের আবার গাইড ছিল। গাইড ছাড়া তো যাওয়া সম্ভব নয়। কেননা এদের পরিবার রয়েছে, ছেলে মেয়ে রয়েছে, মহিলা রয়েছে।

তো সেই পরিবারগুলো এই ধরনের গাইডদেরকে অনেক টাকা পয়সা দিত। আমরা দেখলাম যে একটা গাইড একটা হিন্দু পরিবারকে নিয়ে যাচ্ছে।

আমরা বললাম যে, ভাই আমরাও তো কিছু চিনি না। আমরা কি আপনাদের সাথে আসতে পারি? তখন তারা আমাদের পা হতে মাথা পর্যন্ত ভাল করে দেখল।

দেখে তারা বুঝতে পারল যে আমরা আসলে যাচ্ছি যুদ্ধের জন্য। বুঝতে পেরে আমাদেরকে সাথেই নিয়ে নিল। এই আবার আমরা হাঁটতে শুরু করলাম।

একটু পরেই একটা রেল লাইন ক্রস করতে হলো। সেটা ছিল ঢাকা চিটাগাং রেললাইন। তো রেললাইন ক্রস করে আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম।

হাঁটতে হাঁটতে যখন আমরা শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে উঠলাম, তখন রাত প্রায় একটা থেকে দেড়টা বাজে। শরীরে কিছুই নেই। তিন দিন যাবত ধরে শুধু হাঁটছি আর হাঁটছি।

অত্যন্ত ক্লান্ত দুর্বল চোখে শুধু ঘুম আর ঘুম। পড়ে যাই যাই অবস্থা। তো আমরা ভেবেছিলাম যে ওখানে গিয়েই খেয়ে নিব। কিন্তু গিয়ে দেখলাম যে ওখানে খাওয়ার মতো তেমন কিছুই নেই। এখানে শরণার্থীদেরকে শুধু দুবেলা কোন রকম খাবার দিচ্ছে।

আর ওখানে দুইটা দোকান ছিল সিগারেটের দোকান, কিন্তু তেমন কোনো খাবার পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে কাঁঠাল পাওয়া যাচ্ছিল।

কিন্তু কাঁঠাল কে খায়? কিন্তু ওই সময় আমাদের পেটে এত খিদে, চার আনা কি ছয় আনা দিয়ে আমরা একটা কাঁঠাল কিনলাম।

অত্যান্ত ক্ষুধার্ত অবস্থায় আমরা সেই কাঁঠাল ভেঙে খেলাম। আমরা তো আসলে অল্প বয়স, অনেক কিছু জানতাম না। আমাদের মা সবকিছু তৈরি করে দিতেন। কাঁঠালের আঠা এভাবে হাতে লেগে যায় তা আমাদের জানা ছিল না।

আর সেই আঠা কিভাবে ছাড়াতে হয়, তা আমাদের জানা ছিল না। অনেকে বলল যে বালির মধ্যে হাত ঘষ। আমরা বালির মধ্যে হাত ঘষে একটা সিগারেট ধরালাম। আমি তখন স্মোকিং করতাম।

তো একটা সিগারেট ধরিয়ে দুই টান দেয়ার পরই আমি পড়ে গেলাম। এত ক্লান্ত ছিলাম যে আমি মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর ঠোঁটের থেকে সিগারেটটা আমার বুকের ওপরে পরলো।

ঘুমের মধ্যে সেই সিগারেটটা বুকের উপর থেকে সরিয়ে দিলাম কিন্তু আমার কোন হুঁশ ছিল না। ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙ্গার পরে দেখলাম বুকের উপরে চামড়া জ্বলে গেছে। আমার বুকের সেই পুড়ে যাওয়া চামড়ার দাগ অনেক দিন ছিল।

হয়তো এটা একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা কিন্তু সত্যিকার অর্থেই এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে সিগারেটের আগুনে চামড়া পুড়ে যাচ্ছে অথচ সরিয়ে দেওয়ার মত হুঁশ ছিল না।

যাই হোক, ঘুম ভাঙ্গার পরে ওখান থেকে আমরা মুড়ির টিনের মতো একটা বাসে চরে আগরতলা গেলাম। সেখানে পৌঁছেই আমরা কাউকে চিনিনা, কিছুই চিনি না, সরাসরি চলে গেলাম সিপিএম অফিসে। ওখানে পৌঁছে গেটেই দেখলাম রাশেদ খান মেনন।

মেনন ভাই কে দেখে আমরা কিছু বলার আগেই উনি আমাদের কে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কোথা থেকে এসেছো? আমরা বললাম, ঢাকা থেকে।

আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনন ভাই খুব হতবাক হয়ে গেলেন। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে, শরীরের দিকে তাকিয়ে, আমাদের বয়সের দিকে খেয়াল করে তিনি বললেন যে, তোমরা কিভাবে এসেছো? কত টাকা নিয়ে আসছো? যুদ্ধ করতে চাও কিন্তু যুদ্ধ তো অনেক কষ্টকর জিনিস।

ঠিক মানিক ভাই যেরকমটা বলেছিলেন। মেনন ভাইও একই কথা বললেন। তো আমরা বললাম যে, না, আমরা যুদ্ধ করব। এভাবে বেঁচে থাকা যাবে না।

আমরা এর প্রতিশোধ নেব। যে হত্যাকাণ্ড আমরা দেখেছি, এভাবে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। মেনন ভাই আমাদেরকে সিপিএম অফিসের ভিতর নিয়ে গেলেন। একটা বাথরুম ছিল। সেখানে আমাদেরকে গোসল করতে বললেন।

ফ্রেশ হয়ে একটা ঘরে বিশ্রাম নিতে বললেন। উনি আমাদের জানালেন যে উনি একটা চিঠি লিখে দেবেন আমাদের কাছে। আমরা সেই চিঠি নিয়ে চলে যাব মেলাঘরে।

আমরা তখন গোসলটা করার পরে একটু ফ্রেশ হলাম। স্বাধীনতা পেলাম। কোন ভয় ছিল না যে কেউ আমাদেরকে হত্যা করবে।

তখন বেশ খানিকটা ভালো লাগলো। এর পরে আমরা বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, চলো একটু এই শহরটা ঘুরে আসি। আমরা চার বন্ধু মিলে শহরটা ঘুরে দেখলাম।

কিছু খাবার-দাবার কিনে খেলাম। ঐদিন কি তার পরের দিন আমরা হলে একটা সিনেমাও দেখলাম। তারপর আমরা একটা চিঠি নিয়ে মেলাঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

খুব সম্ভবত ৪০ মিনিট পরে আমরা মেলাঘরে পৌঁছালাম। সেখানে পৌঁছানোর পরে গেটে আমাদেরকে আটকালো। আমরা বললাম যে, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি এবং সেই চিঠিটা দিলাম। এখানে বাদল ভাই নামে আমাদের বাংলাদেশী একজন ছিলেন। আমরা তাঁর কাছে চিঠিটা দেই।

তারপর ক্যাপ্টেন হায়দার ভাই আমাদেরকে রিসিভ করলেন। আমাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছিল। হায়দার ভাই একজন সৈন্যকে ডেকে বললেন যে, দেখো ওরা ঢাকা থেকে এসেছে, এখন তো এখানে খাবার পাবেনা।

তুমি বরং এদেরকে বাহির থেকে খাবার এনে দাও। একথা শুনেই আমাদের খুব খুশি লাগলো যে খাবার পাচ্ছি। কিন্তু খাবার যখন খেতে বসলাম,

একটা রুটি যখন কামড় দিলাম, কামড় দিতেই আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসলো। এতো শক্ত, আটা দিয়ে কোন ভাবে বানানো। সব্জি বলতে তেমন কিছু নাই।

মাসকলাই ডাল। ক্ষুধার্ত অবস্থায় এগুলো দেখে আমরা কান্নায় ভেঙে পড়লাম। যাই হোক, এত কষ্টের পরও আমরা ভেঙ্গে পড়লাম না। আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটুট ছিলাম যে আমরা যুদ্ধ করবোই।

আমাকে আর আমার সাথের আরেকটা বন্ধুকে এই দু'জনকে ১২ নম্বর প্লাটুনে রাখা হয়। বাকি দুইজন বন্ধুর মধ্যে যে বরিশালের ছিল, তাকে বরিশালের প্লাটুনে রাখা হয় আর যে সিলেটের বন্ধুটা ছিল, তাকে সিলেটের প্লাটুনে পাঠানো হয়।

ওদেরকে কত নাম্বার প্লাটুনে পাঠানো হয়েছিল তা আমি এখন স্মরণ করতে পারছিনা। পরের দিন আমাদেরকে ডেকে আমাদের কিছু কাগজপত্র দেয়া হয়। কিছু নোট বই, পেন্সিল দেয়া হয় এবং আমাদেরকে বলে দেয়া হয় যে, সকাল থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণটা কিভাবে ধাপে ধাপে হবে।

পরের দিন আমাদের অফিসার ইনচার্জ ক্যাপ্টেন হায়দার, তার অবদান কোনদিন ভুলতে আমরা পারবো না। যিনি না থাকলে এই মেলাঘরের এত বড় একটা সেক্টর, যার অধীনে অসংখ্য গেরিলা অপারেশন ঢাকায় পরিচালিত হয়েছিল, যিনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি না থাকলে হয়তো এটা সম্ভব হতো না।

উনি একজন কমান্ডো ছিলেন। উনি আমাদেরকে বললেন যে, আমরা তোমাদেরকে চার সপ্তাহের একটা প্রশিক্ষণ দেব। সাধারণত এই প্রশিক্ষণ ৪ মাস থেকে ৬ মাসের হয়।

কিন্তু এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আমরা সেই প্রশিক্ষণকে এক মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তোমাদের অনেক কষ্ট হবে কিন্তু আমি তোমাদেরকে বলব মন দিয়ে প্রতিটা জিনিস শোনার জন্য। কারণ তোমরা যদি একটা জিনিসকে মিস করো, সেটাই তোমাদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

একটা ভুলের জন্য হয়ত তোমাদের জীবন চলে যেতে পারে। সুতরাং যত কষ্টই হোক তোমরা জিনিস গুলো শুনবে। ক্লাস শুরু হবে ভোরে। ভোর বেলার কিছু ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটিসের পরে। পিটি করাতো। আমরা দৌড়ে আসতাম বিভিন্ন জায়গা থেকে।

ফিজিক্যালি ফিট না হলে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। তারপরে নাস্তা দিত। পুরি আর চা। তেলে ভাজা পুরিটা খুব সুস্বাদু ছিল। খেতে খুব ভালো লাগতো। আর চা খেতাম। আমাদের সেখানে গোসল করার মত কোন জায়গা ছিল না।

মেলাঘরের প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে রুদ্রসাগর নামে একটা জায়গা ছিল। এটার পানি আমার বুক পর্যন্ত ছিল। আর কোন টয়লেট ছিল না।

জঙ্গলের ভিতরে আমরা টয়লেট করতাম। দুপুরে রুটি আর ডাল খেতে দিত আর রাতে ভাত, ভাজি, ডাল ও দিত আর সপ্তাহে একদিন মাছ কি মাংস দিত।

যাই হোক, আমরা পরের দিন সকাল থেকে প্রশিক্ষণ শুরু করি। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে প্রায় দুপুর একটা পর্যন্ত রাইফেল, এসএলআর, এগুলি খোলা, জোড়া লাগানো,

পজিশন থেকে আরম্ভ করে সব কিছু শেখানো শুরু হলো। এলএমজি, গ্রেনেড ফায়ারিং পর্যন্ত শেখানো হলো। আমাদেরকে চারটা মাইনর অপারেশন শেখানো হলো। একটা হল এম্বুস, একটা হল রেইড, একটা হল পেট্রোলিং, আরেকটা হল হাইডআউট।

এই চারটা ক্লাস ক্যাপ্টেন হায়দার নিতেন। ব্রিজ কিভাবে ডেমোলিশ করতে হয়। আর আমাদের ফায়ারিং প্রশিক্ষণ দেয় ইন্ডিয়ান আর্মি। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের ক্লাস হত। কিভাবে আর্মস খুলে ক্লিনিং করতে হয়, প্রত্যেকটা অপারেশনের পরে কিভাবে সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হয়,

তারপরে যেখানে আর্মস গুলোকে রাখা হতো সে জায়গাটাকে বলা হতো কোর্প। কোর্পে কিভাবে আর্মসগুলোকে রাখতে হয়, তার সবই শেখানো হতো।

এর মধ্যে যেটা হচ্ছিল, বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা যারা ঢাকা থেকে সেখানে গিয়েছিল প্রশিক্ষণের জন্য, ধরুন ৪০-৫০ পার্সেন্ট মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকায় এসে আর ফিরে যাচ্ছিল না। এর একটা কারণ আমাদেরকে বলা হলো যে এদের ভিতরে একটা ভয় কাজ করত।

সেই ভয়ের কারণে তারা আর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাইত না। আমাদেরকে বলা হলো যে, এদেরকে একবার যদি ব্যাটেলফিল্ড এর যে ফিলিংস সেই অনুভূতিটা যদি একবার উপভোগ করানো যেত, তাহলে এদের ভয়টা কেটে যাবে।

এজন্য আমাদেরকে বলা হলো যে মন্দবাগে পাকিস্তান আর্মির বিপক্ষে আমাদেরকে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে। তো এখানে এক মাস ট্রেনিং। তারপর আমরা ওখানে যাব।

ওখানে আমাদেরকে আবার ১৫ দিনের ট্রেনিং করতে হবে। কিন্তু আমরা সেখানে যাবার পরে আরও একমাস ট্রেনিং করতে হলো।

ওখানে যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদেরকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনেক যুদ্ধ হয়েছে যা কল্পনাও করা যাবে না। তারপর আমরা রাতের বেলাও অনেক অপারেশন ক্যারিআউট করেছি।

৪ ইস্টবেঙ্গলের ক্যাপ্টেন গাফফারের অধীনে আমরা যুদ্ধ করেছি। সেখানে আমাদের প্লাটুন কমান্ডার ছিল সাদেক হোসেন খোকা, সাবেক মেয়র। প্লাটুনের টোয়াইসি ছিল জাকির ভাই। জাকির ভাই ওখানকার একটা অপারেশনে শহীদ হয়ে যান।

উনি শহীদ হয়ে যাওয়ার পরে আমরা মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পড়ি। আমরা তখন বলি যে আমাদেরকে যে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল, সে অনুযায়ী অপারেশন তো হচ্ছে না। আমাদেরকে তো এরকম সম্মুখ যুদ্ধের বা কনভেনশনাল ওয়ারফেয়ারের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি।

আমাদের প্রশিক্ষণটা ছিল ঢাকায় পাঠিয়ে গেরিলা যুদ্ধের জন্য। এই অভিযোগ দেওয়ার পড়ে আমাদেরকে সেখান থেকে মেলাঘরে আবার ফিরিয়ে আনা হল। মেলাঘরে ফিরিয়ে এনে আমাদেরকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে।

এখানে বলে রাখা দরকার যে, ঢাকায় যে অপারেশনগুলো ক্যারিআউট করা হয়েছে, বিভিন্ন গ্রুপ পাঠানো হয়েছিল, সেটা কিভাবে পাঠানো হয়েছিল? সেটা হয়েছিল যে, বড় বড় দলগুলো ঢাকার আশেপাশের বিভিন্ন স্থানে এসে ক্যাম্প স্থাপন করল।

ক্যাম্প স্থাপন করে সেখান থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে ঢাকায় ঢুকে অপারেশন ক্যারি আউট করে আবার তারা ফিরে যেত। ঢাকার আশেপাশে এই ক্যাম্প গুলোকে বেসক্যাম্প বলা হত। তো আমাদেরকে মেলাঘরে ফিরিয়ে এনে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করা হলো।

এর মধ্যে আমরা দেখতে পেলাম ত্রিশ কি একত্রিশ জনের একটা দল নিয়ে শহীদ রেজাউল করিম মানিক, যিনি আমাদেরকে এখানে আসার রাস্তার সন্ধান দিয়েছিলেন, তিনি তার দল নিয়ে চলে গেলেন ওয়েস্ট দিনাজপুরে।

সেখান থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে তারা যখন আর্মস চাইলো, তখন ইন্ডিয়ান আর্মি তাদেরকে বলল যে আমরা তো এভাবে আর্মস দেইনা।

আর্মস নেয়ার জন্য তাদেরকে মেলাঘরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। মানিক ভাইকে মেলাঘরে দেখতে পেয়ে আমি তার সাথে আলাপ করলাম।

তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন যে, তোমাদের কি অবস্থা? আমরা বললাম যে, আমাদের প্রশিক্ষণ শেষ। আমরা এখন অপারেশনে যাব। তখন তিনি বললেন যে, তুমি এক কাজ করো, আমাদের সাথে চলে আসো।

এরমধ্যে ক্যাপ্টেন হালিম, যিনি ছিলেন মানিকগঞ্জের। ধামরাইয়ের দিকে ক্যাম্প খুব কম ছিল। মাত্র তিনটা কি চারটা গ্রুপ। কিন্তু কেরানীগঞ্জ জিনজিরার দিকে অনেক ক্যাম্প ছিল।

আমাদের ৫২ জনের একটা দল গঠন করা হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন শহীদ রেজাউল করিম মানিক। আর আমি, মেজবাহউদ্দিন সাবু, আলতাফ হোসেন টুনি, তিনজন কি চারজন মেলাঘরের দলটার সাথে দেয়া হয়।

আমরা সেখান থেকে বিরাট একটা দল ঢাকায় অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যে স্টার্ট করি। নৌকা ঠিক করে দেয়া হয়।

এখানে ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের যে ব্যাটেলিয়ান ছিল, আমরা সেইদিক থেকে ঢুকি। তো প্রথম দিন আমরা যেদিন এসেছিলাম, সেটা ছিল বর্ষাকাল।

প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা পড়ে যাচ্ছিলাম। চারিদিকে পানি আর পানি। যখন বর্ডার ক্রস করবো, সেই সিএন্ডবি রোডের কাছে রাজাকারের কিছু গ্রুপ আমাদেরকে হেল্প করত। টাকা-পয়সা নিয়ে হোক অথবা যে কারণেই হোক।

তো ওরা আমাদেরকে টর্চলাইট দিয়ে সিগন্যাল দিত। তখন ওই সিগন্যাল দেখে রাত একটা থেকে দুটোর মধ্যে আমরা ক্রস করতাম।

ঐদিন আমাদের আগে ছিল ফরিদপুর গ্রুপ। আমরা পানির মধ্যে লাইনআপ করে থাকতাম। যখনই ওরা টর্চ দিয়ে সিগন্যাল দিত তখন আমরা একটার পর একটা গ্রুপ ইন করত। আগে ফরিদপুরের, তারপর ঢাকার গ্রুপ।

তো সেদিন রাত বারোটার পরে আমরা অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু টর্চের কোন সিগন্যাল পাচ্ছিলাম না। ভাবছিলাম হয়তো রাজাকারের দল ঘুমিয়ে পড়েছে।

তো সিগন্যাল না দেখেই ফরিদপুরের গ্রুপ যেইনা আস্তে আস্তে ব্রিজের নিচে দিয়ে রাস্তা ক্রস করতে শুরু করলো, সাথে সাথে পাকিস্তান আর্মি গুলি শুরু করল। আসলে সেদিন একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটেছিল।

পাকিস্তান আর্মি সেখানে একটা এম্বুস করে রেখেছিল। যে কারণে রাজাকারের দল আমাদেরকে টর্চলাইটের কোন সিগনাল দেয়নি। তো অন্ধকার রাত, চারিদিকে গাছ, পানির মধ্যে কচুরিপানা, ঝোপঝাড়ের মাঝখান থেকে নৌকা চালিয়ে আসতে ছিলাম।

এরকম অবস্থার মধ্যে ওরা দেখে ফায়ার করতে পারেনি। পাকিস্তান আর্মি টার্গেট করে ফরিদপুরের গ্রুপটার উপর ফায়ার করতে পেরেছিল। আমরা পরবর্তীতে জানতে পেরেছিলাম ওই নৌকাটা ডুবে গিয়েছিল।

তিনজন স্পট ডেড আর কতজন আহত হয়েছিল তা আমার জানা ছিল না। আমরা পিছনের নৌকাগুলোতে ঘুমিয়ে ছিলাম কারণ আমরা যেখানে সুযোগ পেতাম সেখানেই একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতাম। কোথায় গিয়ে হাঁটতে হবে, কতখানি পথ হাঁটতে হবে, তার কোন হিসেব ছিলনা।

তবে আমরা কিছু খাবার কিনে সাথে রেখেছিলাম। যাহোক আমাদের আগের দলটা ছিল ফরিদপুরের দল।

ওদের নৌকা থেকে আমাদের নৌকার দূরত্ব ছিল প্রায় ৪০০ গজের মত। ওদের নৌকা আক্রান্ত হওয়ার পরে আমাদের নৌকার দিকে ফায়ার আসতে শুরু করল।

ওরা একেবারে র্যান্ডম ফায়ার করতে শুরু করল। তখন আমরা নৌকা থেকে পানিতে নেমে আস্তে আস্তে নৌকা টেনে টেনে পিছনের দিকে নিতে শুরু করলাম। এরমধ্যে পাকিস্তান আর্মি প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট ফায়ার করল।

পেছনে এসে আমরা আবার আমাদের দলটাকে রিগ্রুপ করতে শুরু করলাম। কারণ একেক জন একেক দিকে চলে গিয়েছিল। আমাদের আর্মস, জিনিসপত্রগুলো আবার গুছিয়ে নিলাম। আর পাকিস্তান আর্মি টুইঞ্চ মটর ফায়ার করল।

এটা একটা সিগন্যাল ছিল একটা ফায়ার শুরু করার জন্য এক ধরনের সিগন্যাল থাকে আবার একটা ফায়ার শেষ করার সময় আরেকটা ফায়ার সিগন্যাল থাকে। টুইঞ্চ মটর ফায়ার সিগন্যাল টা ছিল ফায়ার শেষ করার সিগন্যাল।

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে পাকিস্তান আর্মি পানিকে খুব ভয় পেত। ওরা যে এম্বুস পরিচালনা করেছিল, সেটা যদি আমরা করতাম, তাহলে আমরা সবাইকে মেরে ফেলতে পারতাম।

কিন্তু যেহেতু ওরা পানিকে ভয় পেত, তাই ওরা এম্বুস শেষ করে ফিরে গেল। ওদের এই পানি ভীতির কারণে আমরা বেঁচে গেলাম। আমাদের কাছে টাকা পয়সা যা ছিল ভিজে গেল।

ক্যাম্প থেকে আমাদেরকে কিছু টাকা দেয়া হয়েছিল। আমাদের লিডার দিয়েছিলেন। সে টাকাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করে আমার কাছে কিছু রেখেছিলাম।

যাতে একজন ধরা পরলে আরেকজনের কাছে কিছু টাকা থাকে। তো ওখানে সবকিছু গুছিয়ে আমরা আর সে রাতে ঢাকায় প্রবেশ করলাম না। পরের দিন ফেরত আসলাম। কারণ সবকিছু ভিজে গিয়েছিল। আর্মস এ্যামোনিশন সবকিছু।

এগুলোকে আবার পরিষ্কার করে ঠিকঠাক করে তারপর আবার অপারেশন পরিচালনা করতে হবে। তারপর আমরা ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের যে এলাকা, সেই এলাকায় গেলাম।

সেখানে ক্যাম্পে থাকলাম। পরদিন কর্নেল হায়দার দেখা করতে আসলেন। এসে আমাদের মনবলটা ঠিক করলেন। ঘাবড়ে যেও না, সাহস দিলেন। আসলে উনার মত মানুষ হয় না।

ওনার এই দেশের প্রতি যে ভালোবাসা, এই দেশের মুক্তিযুদ্ধে ওনার যে কন্ট্রিবিউশন। ক্যাপ্টেন হায়দার, কর্নেল খালেদ মোশাররফ। উনাদের মত মানুষ হয় না।

যাদের অবদান আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারব না। তো এরপর আমরা ওখানে দুই দিন থাকলাম। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন আমাদের সবকিছু ঠিকঠাক করে দিলেন।

এইবার আমরা অপারেশনে ব্রিজের কাছে পৌঁছানোর পরে যখন সিগনাল পেলাম, তখন আমরা ক্রস করলাম । কিন্তু ঠিক যখনই আমরা ব্রিজটা অতিক্রম করছিলাম তখনই রাজাকার লোকেরা আমাদেরকে একটু দাড়াতে বলল।

অন্ধকারের মধ্যে আমরা প্রচন্ড রকম ঘাবড়ে গেলাম যে এইবার যদি আমাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে, তাহলে আমরা নির্ঘাত মারা পড়বো। আর নৌকা থেকে পাল্টা ফায়ার করা সম্ভবনা।

আমরা চুপ করে আছি, কোন কথা বলছি না কারণ কথা বললে আমাদের পজিশন ট্র্যাক করে ফেলবে। আমাদের শরীর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসতে শুরু করলো। তারপর রাজাকার লোকটা ব্রিজের উপর থেকে আমাদের কাছে নেমে আসলো।

এসে বলল যে, ভাই, আমার বাড়ি এমন জায়গায়, আমি যদি তাদের পক্ষে কাজ না করি, তাহলে আমাকে তো তারা ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে।

তাই আমি আমার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজাকারের কাজ করছি। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল আপনাদের জন্য কিছু করি। তো আমি ওদের কাছ থেকে এই এক বাক্স গুলি চুরি করে নিয়ে এসেছি।

এগুলো আপনারা নিয়ে যুদ্ধ করুন। এই কথা শোনার পরে আমাদের প্রাণে পানি ফিরে আসলো। তখন আমরা ধন্যবাদ জানিয়ে ওখান থেকে আস্তে আস্তে চলে আসলাম।

তারপর দুইদিন পর্যন্ত নৌকায় ছিলাম। অনেক বড় নৌকা। এই নৌকাগুলোতে পাট বোঝাই করে আনানেয়া করা হত। বিশেষ করে যখন আমরা মেঘনা পারি দিতাম, ওখানে পাকিস্তান আর্মি গানবোটে টহল দিত।

মেঘনা পাড়ি দেয়ার সময় আমরা নৌকার পাটাতনে শুয়ে থাকতাম আর নৌকার উপরের দিকে শুধু মাঝি থাকতো।

এভাবে খুব কষ্ট করে আমরা রোহা নামে একটা জায়গা, ধামরাই মানিকগঞ্জের মাঝামাঝি বেল্টে, এখানে এসে ক্যাম্প স্থাপন করলাম। ক্যাম্প স্থাপন করার পরেই আমাদের কমান্ডার সৈয়দ রেজাউল করিম মানিক, উনি আমাদের বললেন যে, তোমরা এক কাজ করো, তোমরা ঢাকার ছেলেরা ১০ দিনের ছুটি কাটাও। এই আমি ঢাকায় আসি। দশ দিন নয়।

সাত দিনের ছুটি কাটাই। তারপরে আমরা যেটা টের পাই সেটা হচ্ছে পাকিস্তান আর্মি প্রতিটা গ্রাম কন্ট্রোল করতো রাজাকার আলবদর বাহিনী দিয়ে। ওরা নিজেরা থানায় থাকতো আর গ্রামেগঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাপুটে ছিল রাজাকার আলবদর বাহিনী।

সেই রাজাকার আলবদর বাহিনী পাকিস্তান আর্মিদের বিভিন্ন ইনফর্মেশন দিতো, যেমন এই বাড়িতে টাকা পয়সা আছে বা ঐ বাড়িতে চাল-ডাল আছে বা অমুক বাড়িতে সুন্দরী মেয়ে মানুষ আছে। এগুলো জেনে ওরা সেই সমস্ত বাড়িতে রেইড করত।

তো আমরা সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করার পরপরই রাজাকার আলবদর বাহিনী পাকিস্তানি আর্মিদের খবর দিয়ে দেয়। পরেরদিনই পাকিস্তান আর্মি আমাদের সেই রোহা গ্রামে অ্যাটাক করে।

আমরা যখন চলে আসি তখন পনির ভাই নামে একজন ছিল আমাদের সিনিয়র অনেক। উনি ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন। সাথে আরও কয়েকজন ছিলেন।

মোতালেব আরো মানিকগঞ্জের যারা যারা ছিলেন। তো পাকিস্তানি আর্মি দিনের বেলা আমাদের উপর আক্রমণ করেছিল। তখন ছিল সেপ্টেম্বর মাস।

চারিদিকে প্রচুর পানি আর পানি। এইপানি আমাদের জন্য একটা ব্লেসিং ছিল। কারণ ওরা পানি দেখলে আর সামনে আগাতে চাইত না, পানি খুব ভয় পেত। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের উপরে আক্রমণ চালালো। অনেক বড় একটা গ্রাম ছিল।

ওদের ধারণা ছিল আমরা সংখ্যায় অনেক। এজন্য ওরা ভয় পেয়েছিল। তাছাড়া গ্রামে একটা ফায়ার করলে সেই আওয়াজ কোথা থেকে আসছে তার ট্রেস করা যেত না। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। ছোট ছোট ঘর ছিল তখন দালানকোঠা কিছুই ছিল না।

তো আমরা যখন পরের দিন ওই গ্রাম ছেড়ে চলে আসি তখন আমরা ওদেরকে বেশ খানিকটা পথ তারা করে নিয়ে যাচ্ছিলাম।

ওখান দিয়ে একটা নদী আছে। ওখানে বায়রা নামে একটা জায়গা আছে। সেখানে সিংগাইর থানার ওসি কিছু মিলিশিয়া নিয়ে রেশন নিয়ে তিনটা নৌকায় আসছিল। আমরা সেই নৌকায় এম্বুস করি। এম্বুস করে ওদের দুজনকে মারতে সক্ষম হই।

এরপরে ওরা আমাদের ক্যাম্পের লোকেশনটা চিনে যায় তাই আমরা ক্যাম্পের লোকেশনটা শিফট করি। শিফট করার পরে আমরা একটা প্ল্যান করি যে, আমরা প্রতিটা গ্রাম কে রাজাকার, আল শামস, আল বদর, আরো কি কি নাম ছিল, তো এগুলোমুক্ত করব।

তো আমরা রাজাকার কোন কোন বাড়িতে রয়েছে সেগুলো কে সিলেক্ট করে রেইড করা শুরু করি। আস্তে আস্তে ওরা ধামরাই থানাতে ফলব্যাক করে। ওদের গ্রামে থাকার কোন জায়গা ছিল না।

তখন ওরা থানা বেইজড হয়ে যায়। ধামরাই থানা, সাভার থানা, মানিকগঞ্জ থানা, এই থানাগুলো ছাড়া ওদের আর কোন থাকার জায়গা থাকে না। আরেকটা রেডিও ট্রান্সমিটার সেন্টার ছিল। সেখানে পাকিস্তানি আর্মি ছিল।

এভাবে আমরা একের পর এক অপারেশন চালাতে থাকি। আস্তে আস্তে আমাদের ক্যাম্পের এবং এক্টিভিটিস বিস্তার লাভ করতে থাকে।

আমরা একটা জায়গায় ৭ দিনের বেশি ক্যাম্প রাখতাম না। ৭ দিন পর পরই আমরা ক্যাম্প চেঞ্জ করে ফেলতাম।

আর আমরা গ্রামের খুব ভিতর দিকে থাকতাম। তখন এত রাস্তাঘাট ভালো ছিল না। একটা জায়গা থেকে আর একটা জায়গায় যেতে প্রায় চার ঘণ্টা লেগে যেত। পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্প থেকে ওরা কখনো সাড়ে 4 ঘণ্টার দূরত্বে যেত না।

কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করতে ওরা এত দূরে গেলে কোথায় থাকবে? গ্রামের মধ্যে নিরাপদ না। তার উপরে বিভিন্ন দিকে পানি। গ্রামের লোকজনদেরকে ওরা বিশ্বাস করত না। আর গ্রামের লোকজনও ওদেরকে শেল্টার দিত না।

কিছু চিহ্নিত রাজাকাররাই ওদেরকে গাইড করত। এরপরে আমরা সাভার, ঢাকা-আরিচা মেইন রোড থেকে সাড়ে চার ঘন্টা ভিতরে গাজিবাড়ি নামক একটা জায়গায় গেলাম।

ওখানে আমরা একটা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করি। লোকাল এতো গ্রুপ আমাদের কাছে আসতে শুরু করল যে এদের সকলকে ট্রেনিং দেওয়া আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। তো আমরা তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে লাগলাম।

আর্মস কিভাবে খুলতে হয়, লাগাতে হয়, কিভাবে ক্লিন করতে হয়, কিভাবে রিলোড করতে হয়, কিভাবে ফায়ার করতে হয়, এগুলো শিক্ষা দিলাম কিন্তু প্র্যাকটিক্যালি ফায়ার প্রশিক্ষণ দিতে পারলাম না। কারণ কোথায় ফায়ার করবে?

ফায়ার করলেই তো আমাদের অবস্থান চিহ্নিত হয়ে যাবে। গাজী বাড়িতেই পাকিস্তান আর্মির হেলিকপ্টার এসে দুই বার ঘুরে গেল।

তো হেলিকপ্টার যখন আসলো, তখন আমরা সবাই পালিয়ে গাছের আড়ালে চলে গেলাম। ওরা এসে কিছুই দেখতে না পেয়ে ফিরে গেল। আমাদের ক্যাম্পটা খুব অর্গানাইজড ছিল। রেজাউল করিম মানিক একজন সত্যিকার অর্থেই চমৎকার লিডার ছিলেন।

উনি অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান করতেন। উনি প্রত্যেকের কথা ঠান্ডা মাথায় শুনতেন। ভারত থেকে যারা ট্রেনিং নিয়ে আসতো, তাদেরকে আমরা আলাদা কক্ষে রাখতাম। উনি প্রত্যেকের সাথে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে আলোচনা করতেন। য

দি কোন রাজাকার ধরা পড়ত, উনি আমাদের সাথে আলাপ করতেন যে একে কি করবো, ওতো বলতেছে ভালো হয়ে যাবে, মানুষ হয়ে যাবে। আমাদের ক্যাম্পে বিচার হতো কিন্তু আমরা কখনো কারো ক্ষতি করিনি। যখন আমাদের চারিপাশে সম্পূর্ণরকম রাজাকার মুক্ত হয়ে গেল তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা ঢাকায় অপরেশন করব।

ধামরাই এলাকায় আমাদের অপারেশন সম্পূর্ণ সফল হল। ধামরাই সম্পূর্ণরকমভাবে রাজাকার, পাকিস্তানি আর্মি, সবকিছুথেকে পুরোপুরি নিরাপদ হয়ে গেল। সে সময় আমরা প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ দিয়ে ফেললাম।

আমরা তখন ওপেন ঘুরে বেড়াতাম। কোন রকম ভয় আতঙ্ক কাজ করত না। যদি পাকিস্তানি আর্মি আসত তাহলে আমরা লুকিয়ে যেতাম।

আমাদের প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন দূর থেকে আমাদের সংবাদ সংগ্রহ করে এনে দিত। সাইকেলে করে তারা সেখানে যেত, সেখান থেকে সংবাদ নিয়ে এসে আমাদের কাছে পৌঁছে দিত যে কোন শত্রু আছে কিনা, আমাদের শত্রু তখন একমাত্র পাকিস্তান সেনা।

ঢাকায় প্রথম আমরা অপারেশন করি ডিআইটি যেটা পাকিস্তান টেলিভিশন সেন্টার ছিল ওখানে আমাদের প্রথম অপারেশন ছিল।

সেই অপারেশনে মাহাবুব নামের একজন লোকাল স্টাফ ছিল। সে আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে জয়েন করে এবং সে সেখানে এক্সপ্লোসিভ লাগায়। এরপরে আমি মানিক ভাইকে বললাম যে, ভাই আমি ঢাকাতে একটা অপারেশন করতে চাই।

মানিক ভাই বললেন তুমি ঢাকাতে অপারেশন কেন করতে চাও। আমি বললাম, ঢাকাতে যে বিদেশি মিডিয়াগুলো রয়েছে, বিবিসি বা ভয়েস অব আমেরিকা, এদেরকে, ঢাকাবাসীদের কে আমরা আমাদের প্রেজেনসটা বুঝাতে চাই। মানিক ভাই বললেন, তুমি কি করতে চাও? আমি বললাম যে আমি একটা পেট্রোল পাম্প উড়িয়ে দিতে চাই।

তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার কয়জন লোক লাগবে। আমি বললাম চারজন লোক লাগবে। তবে মেলাঘর ট্রেইন্ড লোক লাগবে, যে বুঝে পেট্রোল কি, এম্বুস কি, হাইড আউট কি, এরকম। তিনি বললেন ঠিক আছে তুমি টুনি কে নিয়ে যাও।

টুনি খুব ভালো বোঝে। তুমি আগে ওকে নিয়ে লোকেশনটা দেখে আসো ডিটেইলস প্ল্যান করো। আমি টুনিকে নিয়ে গেলাম। প্ল্যান করলাম কাকরাইল পেট্রলপাম্প উড়িয়ে দেব। প্ল্যান করলাম পহেলা নভেম্বর রমজান মাসে ঠিক ইফতারের আগে।

প্লান মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে পেট্রোলপাম্প উড়িয়ে দিলাম। এরপরে আমরা বায়তুল মোকাররমের কাছে অপারেশন করলাম। সেখানে একটা বিশাল এক্সপ্লোশন হলো। এর পরে আমরা একটা অপারেশন করলাম জোনাকি ব্যাংকে। সেখান থেকে টাকাগুলো লুট করে নিলাম।

টাকাগুলো ইন্ডিয়াতে পাঠিয়ে দিলাম কারণ এই টাকাগুলো সেখানে প্রশিক্ষণরত বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের মধ্যে দিয়ে দেয়া হতো। ক্যাম্প পরিচালনা করা, সেখানে খাওয়া দাওয়া, এই টাকাগুলো এভাবেই আসতো। এগুলো অনেক খরচের ব্যাপার ছিল।

যাহোক, এই অপারেশনগুলো পরিচালনার পর মানিক ভাই ১২ ই নভেম্বর আমাদেরকে বললেন যে তিনি একটা বড় অপারেশন পরিচালনা করতে চান। ঢাকা আরিচা রোডের সব থেকে বড় যে ব্রিজটা রয়েছে, সেটা তিনি উড়িয়ে দিতে চাইলেন।

তো তার নেতৃত্বে ১৪ই নভেম্বর আমরা সেই অপারেশনে যাই এবং এই অপারেশনেই মানিক ভাই শহীদ হয়ে যান। মানিক ভাইয়ের শহীদ হয়ে যাওয়ার পর আমরা মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পরি। তারপর নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু আমাদের নেতৃত্ব দেন। তারপর ঘোষবাগে একটা এম্বুস করি।

পাকিস্তান আর্মি যখন টাঙ্গাইল থেকে কাশিমপুর হয়ে সাভারে পালিয়ে আসতে শুরু করে, তখন আমাদের প্রশিক্ষিত গ্রামের লোকজন তারাই আমাদেরকে ইনফর্মেশন দেয়, যে এখান থেকে পাকিস্তান আর্মি বাহিনী যাবে। তো আমরা সেখানে অপারেশন করে পাকিস্তান আর্মির প্রায় ৪-৫ জন সেনাকে হত্যা করি।

এটা ছিল খুব সম্ভবত ১৪ই ডিসেম্বর। এরপর যখন ১৬ই ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান আর্মির ওয়ান ওয়ান কমিউনিকেশন জোন ঢাকার দিকে আসছিল তখন আমরাও এটার পাশ দিয়ে এসে এসে ওই দিন রাতেই ঢাকায় ঢুকে যাই।

পরদিন সকাল বেলা আমরা রিগ্রুপিং করে ক্যাম্পে যাই। ক্যাম্পে গিয়ে সমস্ত জিনিসপত্র গুছাই।

বিভিন্ন অপারেশনে, বিভিন্ন অ্যামবুশে আমরা পাকিস্তান আর্মিদের কাছ থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র জব্দ করি। বেশ বড় একটা ঘর ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র আমাদের কাছে ছিল। ঘোষবাগ এম্বুস এর সময় পাকিস্তানের আর্মিদের কাছ থেকে আমরা দুটো বড় মেশিন গান জব্দ করি।

যাহোক সেই অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদ নিয়ে আমরা প্রায় চারশ কি সাড়ে চারশ মুক্তিযোদ্ধা, ওখানে আমরা ছিলাম ৫২ জন আর বাকি মুক্তিযোদ্ধারা ছিল লোকাল ট্রেইন্ডআপ।

আমরা সবাই ঢাকায় আসি এবং পল্টনে আমাদের ক্যাম্প স্থাপন করি। যখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন আমি আবার পড়াশোনায় ফিরে আসি। মেট্রিক পরীক্ষা দেই, এইচএসসি পরীক্ষা দেই।

তারপর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ভর্তি হই। সেখান থেকে আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করি এবং ২০০১ সালে কর্নেল পদবী নিয়ে সেনাবাহিনী থেকে রিটায়ার্ড করি।

এরপরে আমি বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করেছি আর এখন আমি পুরোপুরি রিটায়ার্ড জীবন যাপন করছি।

নতুন প্রজন্মকে আমি প্রথমেই বলতে চাই যে, তোমরা দেখো যে তোমরা ঘুরে বেড়াচ্ছ, আর তোমাদেরকে পাকিস্তান আর্মি গুলি করে মারছে, এটা কখন হতে পারে?

যখন তারা তোমাদেরকে কখনোই বন্ধু হিসেবে মেনে নেয়নি। ওরা সব সময় বাঙালিদেরকে কিভাবে দাবিয়ে রাখা যায়, কিভাবে বাঙ্গালীদের ধন সম্পদ লুট করা যায়, এরকম চিন্তায় ছিল। এটার কারনেই তারা বাংলাদেশকে কখনো ছাড়তে চায়নি।

তোমরা খেয়াল করে দেখো, বাংলাদেশ আজকে কত এগিয়ে গিয়েছে। তোমরা আজকে অনলাইনে গিয়ে দেখো, আমরা যখন যুদ্ধ করেছিলাম তখন বাংলাদেশের দুই টাকা সমান সমান পাকিস্তানের এক টাকা ছিল, অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশি দুই টাকা দিয়ে পাকিস্তানের এক টাকা কিনতে পারতাম।

আর আজ পাকিস্তানের দুই টাকা দিয়ে বাংলাদেশের এক টাকা কিনতে হয়। আমরা বাঙালিরা আরও অনেক ভালো করতে পারতাম যদি ওরা আমাদেরকে সেই সময়ে ওভাবেই লুটেপুটে না খেত। আমি শাহীন স্কুলে পড়তাম।

সেখানে আমি দেখতাম যে বাঙালিরা বাংলা বলার চেয়ে উর্দু বলার প্র্যাকটিস করছে। এখন তো আমরা বাংলা বলি। বাংলা আজ মর্যাদায় কত উপরে চলে গিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের একুশে ফেব্রুয়ারি আজ সারা পৃথিবীব্যাপী পালন করা হয়।

আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সর্বদিক থেকে আমরা পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছি। পাকিস্তান এখন আফসোস করে যে কি তারা হারিয়েছে।

আমাদেরকে তারা কখনোই তাদের নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করেনি। তারা সবসময়ই চেয়েছে এই জাতিটিকে যতদিন লুটেপুটে খাওয়া যায়।

পাকিস্তান আর্মিতে ওই সময়ে বাঙালির সংখ্যা ছিল দুই থেকে তিন পার্সেন্ট। চাকরিতে তখন ক’জন বাঙালি সুযোগ পেত?

চাকরিতে তো এখন বাংলাদেশে ১০০ জন সেক্রেটারি থেকে থাকলে দেখা যায় সেই ১০০ জনই বাংলাদেশি। আর পাকিস্তান আমলে ১০০ জনের মধ্যে ৫ জন ছিল বাংলাদেশি।

এখন যদি বাংলাদেশ আর্মি তে ১০০ জন জেনারেল থেকে থাকে তাহলে সেই ১০০ জন বাংলাদেশি। কিন্তু পাকিস্তান আমলে দেখা গেছে সেই জেনারেলদের মধ্যে একজন বাঙালি নেয়া হতো, যেখানে শতকরা ৫৬ জনের উপরে আমাদের থাকার কথা ছিল।

তো আমাদের চাকরিতে ব্যবসাতে সবদিকে সুযোগ-সুবিধা। এখন যে যা করছে, আমার বাঙালি ভাই করছে। সবদিক থেকে আমরা বাঙালিরাই কাজ করছি।

এই সুযোগ সুবিধা আমরা কোনদিনই পেতাম না। তারপরও তারা আমাদেরকে যেভাবে মেরেছে ! আরো একটা জিনিস তারা করেছে, সেটা হচ্ছে আমাদের মেয়েদেরকে টর্চার করেছে।

আমাদের ক্যাম্পে একজন রাজাকারকে হত্যা করেছি, কারণ তার একমাত্র দায়িত্ব ছিল কোন বাসায় মেয়ে রয়েছে, সেই সন্ধান পাকিস্তান আর্মিদেরকে দেওয়া। খবর দিলে রাতে ধরে নিয়ে যেত। এরকম অনেক ঘটনা রয়েছে, যে এই দুঃখের কথা কষ্টের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

আমার আপন চাচা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন। ওনাকে ঐ এলাকায় যখন ময়মনসিংহে ডিউটিতে ছিলেন, যেদিন পাকিস্তান আর্মি যায়, সেইদিন থেকে উনি গুম হয়ে যান।

আজ পর্যন্ত আমরা তার ডেডবডিও পাইনি, কোনো খোঁজও পাইনি। কতটা অমানুষ হলে পরে একাজগুলো তারা করতে পারে? আমাদের সাথে পাকিস্তানের কোনদিনই সুসম্পর্ক সম্ভব না।

ওরা সুসম্পর্ক তখনই করবে যখন প্রয়োজন হবে। তোমরা দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাও, সৎ পথে থাকো। এ দেশ তোমার থেকে অনেক কিছু আশা করে।

আমাদের যা দেওয়ার ছিল তা আমরা দিয়েছি। আমাদের দেয়া শেষ। এখন তোমাদের সময়। তোমরা পতাকা ধরো, দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাও।

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles
Recent Articles