২০ বছর আগেও মানুষের চিন্তা ধারার অনেকটাই বাইরে ছিল এই সিঙ্কহোল শব্দটি। মূলত আগাম কোনো সংকেত ছাড়া মাটি দেবে গিয়ে বিহদ আকার গর্ত সৃষ্টি হওয়াকেই সিঙ্কহোল বলে। এই ব্যপারটা খুবই ইন্টারেস্টিং লেগেছিল যখন সর্বপ্রথম সিঙ্কহোল সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পারে। প্রথমে তারা ভেবেছিল অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যাবহারের কারনে ভূতলে ঘাটতি দেখা দেয়ায় মাটির উপরের ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় সিঙ্কহোল হয়।
কিন্তু আরও অনেক কারনেই এটা হয়, যেমন, মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত বালি উত্তলনের ফলে মাটি তার শক্তির ভারসাম্য কম পায়, যেজন্য উপরের ভবন বা মাটি তার ভর হারায় আর তা নিচের দিকে নেমে যায়। কিন্তু কিছুদিন আগে ইজরাইলে একটা ভয়ানক সিঙ্কহোল সবার মাথা নাড়িয়ে দেয়।
কারন ওই জায়গাটা ছিল পূর্ব পরিক্ষিত, প্রাকৃতিক কারণে ভূগর্ভের মাটির ঘাটতির জন্য এটা হয়েছিল। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক কারণে তৈরী হওয়া সিঙ্কহোল হলো তুর্কীতে।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সিঙ্কহোল তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে। এর পরের অবস্থানেই তুরস্কের কোনিয়া। মাত্র এক বছরেই দ্বিগুণ হয়েছে দেশটির দানবগর্ত। চলতি বছরই সন্ধান মিলেছে ৬ শতাধিক সিঙ্কহোলের। চীন আর রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলেও বিশালাকার গর্ত আছে বেশ কয়েকটা।
গেল বছর ডিসেম্বরে এক ভূমিকম্পের পর একশর বেশি সিঙ্কহোল তৈরি হয় ক্রোয়েশিয়ায়। গত এক মাসে তুরস্ক, ইতালি, মেক্সিকো, ইসরায়েলের পর এবার ভারতেও তৈরি হয়েছে সিংকহোল।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কয়েক দশক এমনকি শতাব্দী লাগে একটি সিঙ্কহোল তৈরি হতে। ইউএসজিএস বলছে, ভূগর্ভস্থ পানি অথবা খনিজ উত্তোলন করা হলে মাটির অভ্যন্তরে ফাঁপা জায়গা তৈরি হয়। নিচের স্তরের মাটি যখন ভূমির উপরের চাপ নিতে পারে না তখনই ধসে পড়ে আর তৈরি হয় বিশালাকার গর্ত।
এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় দানবীয় গর্ত পাওয়া গেছে সাইবেরিয়ায়। যা ছিল প্রায় ১ কিঃ মিঃ রাস্তার সমান।
তবে শহুরে এলাকায় সিঙ্কহোল হলে এটার ভয়াবহতা খুব মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। কারণ কোনো উঁচু দালান যদি একবার মাটির অতল গহবরে হারিয়ে যায় তাহলে কতগুলো মানুষ এক নিমিষে নিশ্চিহ্ন হবে ভাবুন। এধরণের ঘটনা ইতোমধ্যে পৃথিবীর বুকে ঘটে গেছে।
তবে এতে কেউ মারা যায় নি কারণ তার আগেই কিছু সংকেত আশেপাশের মানুষ পেয়েছিল। যখন সিঙ্কহোল ঘটে তখন এর ফলে অবকাঠামোর ক্ষতি হয়, মাটির ওপরের কাঠামোর আংশিক এবং সম্পূর্ণ পতন ঘটে, উচ্চ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া এবং বাস্তুচ্যুত হয় এবং কিছু বিরল ক্ষেত্রে প্রাণহানির কারণ হয়।
আমাদের দেশও এই দূর্যোগের বাইরে নয় কিন্তু। জেনে অবাক হবেন যে বগুড়ার কাহালু উপজেলার একটি মাছভর্তি পুকুরের নিচে আকস্মিকভাবে গর্ত তৈরি হয়ে মাছসহ সম্পূর্ণ পুকুরটি উধাও হয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পরশু রাতে পানি মাঝ পুকুরে পাক খেতে শুরু করে।সকালে দেখা যায় পুরো পুকুর উধাও হয়ে গিয়েছে।
এখানে আসলে প্রাকৃতিকভাবে একটি sinkhole বা ডুবো গর্ত তৈরি হয়েছে। পুকুরের নিচের মাটির নিচে যে পানির স্তর রয়েছে তার প্রবাহের ফলে নিচের মাটি ধুয়ে গহ্বর তৈরি হয়। ধীরে ধীরে মাটি ধুয়ে গহ্বর বড় হতে থাকে। উপরের মাটি অভিকর্ষের টানে সেই গহ্বরে পড়তে থাকে।
ফলে মূল মাটির স্তরে একটি গহ্বর তৈরি হয়।ধীরে ধীরে গহ্বর বড় হতে হতে উপরের মাটির ছাদের পুরুত্ব কমে এসে পানির চাপে ধসে পড়ে উন্মুক্ত হয় এবং সমস্ত পানি তাতে চলে যায়।
বেসিনের ছিদ্র দিয়ে পানি যেমন পাক খেতে খেতে বের হয় এখানেও তাই হয়েছে। এ ধরনের ডুবোগর্তকে কভার-কোলাপস সিংকহোল বলে। অন্ধকার পরিবেশে থাকতে অভ্যস্ত না হওয়ায় মাছগুলোর মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সাধারণ সিঙ্কহোলগুলিকে ভূতাত্ত্বিকরা "কার্স্ট ভূখণ্ড" বলে ডাকে। এগুলি এমন অঞ্চল যেখানে ভূ-পৃষ্ঠের নীচের পাথরের ধরনগুলি প্রাকৃতিকভাবে ভূগর্ভস্থ জলের মাধ্যমে দ্রবীভূত হতে পারে। দ্রবণীয় শিলাগুলির মধ্যে রয়েছে লবণের বিছানা এবং গম্বুজ, জিপসাম, চুনাপাথর এবং অন্যান্য কার্বনেট শিলা।
উদাহরণস্বরূপ, ফ্লোরিডা এমন একটি এলাকা যা মূলত চুনাপাথর দ্বারা আবদ্ধ এবং সিঙ্কহোলের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল।
যখন বৃষ্টিপাতের পানি মাটির মধ্য দিয়ে নিচে চলে যায়, তখন এই ধরনের শিলা দ্রবীভূত হতে শুরু করে। এটি ভূগর্ভস্থ স্থান এবং গুহা তৈরি করে।
সাধারণ ক্রিয়াকলাপগুলি যা ভুগর্ভকে সিঙ্কহোলের দিকে পরিচালিত করতে পারেঃ
মাটির ব্যাঘাত - মাটির স্তর দিয়ে খনন, মাত্রাতিরিক্ত মাটি অপসারণ, ড্রিলিং বা গভীর খনন। পানির বিন্দু-উৎস - ফুটো জল/নর্দমার পাইপ, পানির ইনজেকশন। জল প্রবাহের ঘনত্ব - ঝড়ের জলের ড্রেন, সোয়ালস, ইত্যাদিজল আটকানো - অববাহিকা, পুকুর, বাঁধ, এরকম বিভিন্ন কারণেই এটা হতে পারে।
সিঙ্কহোল কয়েক ফুট থেকে শত শত একর এবং 1 থেকে 100 ফুটের বেশি গভীরে পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু দেখতে অগভীর বাটি আকৃতির হয় যেখানে অন্যদের উল্লম্ব দেয়াল আছে; কেউ কেউ পানি ধরে প্রাকৃতিক পুকুর তৈরি করে।
যাইহোক, এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে গভীর সিঙ্কহোল হলো চীনের জিয়াওহাই তিয়ানকেং, যার গভীরতা 2,172 ফুট। এই সিঙ্কহোল, যা "দ্য হেভেনলি পিট" নামেও পরিচিত, এটি 1994 সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল।
দারুণ লেখনি!
You must be logged in to post a comment.