বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (প্রকৌশলী) শহীদউল্লাহ চৌধুরী, এনডিসি (অবঃ)

আমি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদউল্লাহ চৌধুরী এনডিসি (অবসর প্রাপ্ত)। আমি ১৯৭১ সালে এসএসসি পরিক্ষার্থী ছিলাম। ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে একটা ক্রিকেট খেলা হচ্ছিলো, আমি ও স্টেডিয়ামে বসে ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম।

হঠাৎ করে শুনলাম যে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় যে পার্লামেন্টের একটি সেশন হওয়ার কথা ছিল, সেটা সে পোস্টপোন্ড করে দিয়েছে। এখবরে জনতা ও যারা ভিতরে দর্শক ছিল সবাই উত্তেজিত হয়ে খেলাটা পন্ড করে দিল। এবং এরপরে আমরা বেরিয়ে লোকজনের পিছনে পিছনে হোটেল পূর্বাণীতে আসলাম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বানী হোটেলে উনি একটা সাংবাদিক সম্মেলনের ডাক দিলেন। আমরা ওখানে গেলাম। আসলে যে আমি ওই সংবাদ সম্মেলনে  গিয়েছিলাম, সেটা ঠিক কোন একটা উদ্দেশ্যে যাইনি। কারণ আমি একটা কিশোর ছিলাম। এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে, তো উনারা যাচ্ছে আমরাও গেলাম।

ওখানে বঙ্গবন্ধু ওনার ভিন্ন আদেশ জারি করলেন, বললেন যে আজ থেকে সারাদেশে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য অবরোধ হবে। স্কুল—কলেজ বন্ধ থাকবে, অফিস—আদালত বন্ধ থাকবে এবং কোন বাঙালি রেডিও বা টেলিভিশনে পাকিস্তানিদের কোন সংবাদ প্রচার করবে না, এরকম অনেক নির্দেশনা দিলেন।

ওখান থেকে আমি চলে আসলাম। তারপরে ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্পোর্টস গ্রাউন্ডে আমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেল। ওই প্রশিক্ষণটা যে কি, কেন প্রশিক্ষণটা হচ্ছে বা কি হচ্ছে, সেসব না বুঝেই ওখানে চলে গেলাম।

ওখানে গিয়ে আমরা স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা প্রথমে পিটি প্যারেড করি, কাঠের রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং নেই। ৭ ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দিন ঠিক হল এবং ঢাকা শহরে তখন চরম উত্তেজনা, আমরা ভাবলাম যে বঙ্গবন্ধু ঐদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন।

এবং আমাদের দৃষ্টিতে স্বাধীনতার ঘোষণা মানেই হলো উনি বলবেন যে আজকে থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে ডিক্লেয়ার করে দিলাম। উনার বক্তৃতা শুনলাম, ওনার বক্তৃতা শুনে আমি শুধু না অলমোস্ট সবাই আমরা একটু ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে গেলাম।

কারণ উনি এমন কিছু বললেন না, উনি যদিও লাস্টে বললেন যে "এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম" কিন্তু এর বাইরে আর অন্য কিছু বলেন নাই। বললেন যে, তোমরা যে যার অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হও, এই করো সেই করো কিন্তু আমরা তখন খুব বেশি খুশি হতে পারিনি।

যাহোক আজকে আমি বুঝি যে উনি অনেক বিজ্ঞ ও জ্ঞানী লোক ছিলেন। ঐদিন যদি উনি এর বাইরে অন্য কোন কথা বলতেন, তাহলে কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কিনা আমার সন্দেহ আছে।

কারণ আপনারা জানেন যে ৭০ দশকে পৃথিবীজুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি একটা নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। উনি যদি স্বাধীনতার ডিক্লারেশন দিতেন তারমানে ইস্ট পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তাহলে সারা বিশ্বের যে সাপোর্ট সেটা আমরা পেতাম না।

আর দ্বিতীয় কথা হল উনি পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির লিডার। উনার কাছে ওয়ান হান্ড্রেড এন্ড সিক্সটি সেভেন এমপি আছে। তো সেই হিসেবে উনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন।

তাই উনি এটা বলতেই পারেন না। যাই হোক, ঢাকা ইউনিভার্সিটির মাঠে আমাদের প্রশিক্ষণ চলছে। এদিকে পাকিস্তানি অথরিটির সাথে ইয়াহিয়া খান, ভূট্রো ওান্যান্য সবার সাথে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছে।

তখন আমরা একটা দোলাচলের মধ্যে আছি আসলে কি হবে। যেহেতু যুদ্ধ একটা কঠিন বিষয়। এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদের কারোরই ছিল না। আমরা অনেকে একটা রঙিন স্বপ্নের মতোন জগতে ছিলাম,

মনে হয় যে আমরা এরকম কাঠের রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করতেছি, আর ভাবছি এই পাকিস্তান আর্মির যে মডার্ন ওয়েপন যাদের কাছে আছে তাদের সাথে আমরা মনে হয় এমনি জিতে যাব।

এভাবে ২৫ শে মার্চ চলে আসলো। আমাদের বাসা ঢাকার বকশীবাজার, ২৫ তারিখ রাতের ১ টার দিকে আমার বাবা আমাদের ঘুম থেকে উঠালো, আমি আমার ইমেডিয়েট বড় ভাই আমরা দুজন আমাদের বাড়ির একতালায় একটা রুমে ঘুমাই।

উনি এসে খুব দরজা ধাক্কাচ্ছেন। আমরা ঘুম থেকে উঠে বললাম, কি হইছে? কি হইছে? উনি বললেন যে, “তোরা কি মরে গেছিস নাকি?

সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।” আমি বললাম, কি বলছেন আপনি সব শেষ হয়ে যাচ্ছে! উনি বললেন, “ছাদে যা।” আমাদের বাড়ীটা তিনতালা, তিনতালার ছাদে গিয়ে দেখি যে শহীদ মিনার এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটির এলাকার দিকে অনেক বিস্ফোরণের আওয়াজ। ট্রেসার বুলেটের অনেক আলো হয়,

সেই আলোটা দেখা যায় এবং গোলাগুলির আওয়াজ আমরা শুনতে পেলাম। সেই রাত্রে আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না আসলে কি হতে যাচ্ছে। পরদিন সকালে আমার তিন নম্বর ভাই, উনি একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত, উনি বললেন যে, বিবিসিতে বলছে যে আর্মি ক্র্যাকডাউন করেছে।

তারপর সকালবেলা ৯ টার দিকে রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষণা আসলো, ইয়াহিয়া খান ভাষণ দেবে। আমরা সেই ভাষণটা শুনলাম। সেই ভাষণের মোদ্দা কথা হলো যে, শেখ মুজিবুর রহমান দেশকে ধ্বংস করার জন্য চেষ্টা করছে। আওয়ামীলীগ তাকে সহযোগীতা করতেছে।

সেজন্য তাদেরকে সায়েস্তা করার জন্য, দেশকে বাঁচানোর জন্য পাকিস্তান আর্মি মাঠে নেমেছে এবং তারা জরুরী অবস্থা ঘোষনা করেছে। ঐদিন বেলা ১২টার দিক থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়েছিলো, ঐদিন থেকে কারফিউ জারী করা হয়েছিলো। 

১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ থাকবেনা। আমাদের পাড়াতে বন্ধু—বান্ধবরা কারফিউ থাকলেও আসলো, তো আমরা বললাম চল, আমরা দেখে আসি কোথায় কি হলো। একজন এস,এস,সি এক্সামিনি ১৪—১৫ বছরের ছেলে, তাঁদের তো অত চিন্তাধারা নেই যে কি হতে পারে বা কি বিপদ আসতেছে।

আমাদের বাসা থেকে দুই কি আড়াই কিলোমিটার দূরে জগন্নাথ হল। আমরা আমাদের বাসা থেকে সোজা যে রাস্তা গেছে, সেটাই জগন্নাথ হল ক্রস করে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছে, সেই পথে হাটতে হাটতে জগন্নাথ হলের দিকে গেলাম। গিয়ে দেখি যে মাঠের মধ্যে অনেক মাটির গর্ত করা।

ওখানে ভিতরে গিয়ে দেখি যে অনেকগুলো ডেডবডি আছে। ঠিকমত বুঝা যায়না, দুই একটার হাত বেরিয়ে আছে। দুই একজনের মাথার চুল দেখা যাচ্ছে।

এরকম অনেকগুলো বডি দেখলাম কিন্তু কতগুলো বডি, সেটা বলতে পারবনা। তারপর ওখান থেকে হাটতে হাটতে ইকবাল হল যেটা বর্তমানে জহুরুল হক হল, ওখানে গেলাম। ওখানে ৩ টা ডেডবডি দেখলাম।

জহুরুল হক হলের গেটের মুখে একটা পুলিশের ডেডবডি আর ক্যান্টিনের ছাদে একটা মাঝ বয়েসী লোক ও একটা ছেলের ডেডবডি দেখলাম।

ওখান থেকে আমরা পলাশীর ফায়ারব্রিগেডের দিকে গেলাম। ওখানে গিয়ে আমি ২৩টা ফায়ারম্যানের লাশ দেখতে পেলাম। ওদেরকে এক সাড়িতে মারা হয়েছে।

এই জিনিসগুলো দেখে আমার মনে হলো যে আমরা বোধহয় শেষ হয়ে গেলাম, ধ্বংস হয়ে গেলাম, আমাদের বাঙ্গালীর আর কোনো আশা ভরসা রইলনা। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। এবং খুব অসহায় লাগতেছিলো।

২৬ তারিখ সন্ধ্যার দিকে আমাদের বাসায় একটা মিটিং হলো। আমাদের বাসার ৩ তালার ভাড়াটিয়ার ২টা ছেলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।

আমার সেজ ভাই ইউনিভার্সিটির লেকচারার। আমরা সব ভাইয়েরা সবাই মিলে বসলাম এখন আমাদের কি করা উচিৎ বা করনীয় কি?

তখন তো আমাদের সামরিক কলাকৌশল সম্বন্ধে কোনো ধারনাই ছিল না, তাই যার যেটা মনে হচ্ছে, সেটা বলতেছে। মিটিং এ সিদ্ধান্ত হলো যে আমরা আর্মিকে ঠেকানোর জন্য ব্যারিকেড দিব,

আমাদের ওখানে কংকৃটের বড় বড় পাইপ পড়ে ছিলো, কন্সট্রাকশন কাজের জন্য আনা হয়েছিলো, একটা নষ্ট পিকাপ ছিলো, এগুলো দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়ার চিন্তা করলাম।

সেভাবে আমরা আমাদের বাসা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় যতগুলো পাইপ পেয়েছিলাম, সেগুলোকে দিয়ে ব্যারিকেড দিলাম। ২৬ তারিখ পার হয়ে গেলো।

২৭ মার্চ সন্ধায় চট্রগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বিদ্রোহের কথা জানতে পারলাম। এখবরটা আমাদেও অনেক উজ্জীবিত করেছিল। ২৯ কি ৩০ তারিখের দিকে আমাদের বাসায় আরেকটা মিটিং অনুষ্ঠিত হল। যারা আগেরদিনের মিটিং এ ছিলো, তারা থাকলো।

আমরা আলোচনা করতে লাগলাম, আমরা যে ব্যারিকেড দিলাম, তা দেখে যদি আর্মি আমাদের এলাকার লোকজনদের মেরে ফেলে, তাহলে কি হবে?

আর এধরনের ব্যারিকেড তো কিছুইনা, একটা ধাক্কা দিলেই তো সরে যাবে। তখন আবার সিদ্ধান্ত হলো, আমরা ব্যারিকেডগুলো সরিয়ে দিব, কারন এতে কোনো লাভ নেই।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ব্যারিকেডগুলো সরিয়ে ফেললাম। এভাবে ২রা এপ্রিল পর্যন্ত আমরা পার করে দিলাম।

২রা এপ্রিল থেকে ঢাকা শহরে কারফিউটাকে রিলাক্স করে ফেলা হয়েছে। দিনের বেলা কোনো কারফিউ নেই, রাতের বেলা শুধু কারফিউ বহাল রাখা হলো।

তো আমাদের বাসার সামনের রাস্তাটা উর্দূরোড হয়ে একদম চকবাজার হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে গিয়েছে। ২রা এপ্রিল থেকে দেখছি যে, হাজার হাজার লোক ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ভাবতে লাগলাম আমরা কোথায় যাবো? আমাদের গ্রামের বাড়ী চিটাগাং।

সেখানে যাওয়ার মত রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়ার তেমন কোনো ব্যাবস্থা নেই। এছাড়া ঢাকার কাছাকাছি কোনো গ্রামেরও তেমন কেউ পরিচিত নেই। এভাবে ২—৩ দিন ধরে আমরা দেখলাম যে হাজার হাজার লোক বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে ঐদিকে গেলো।

পরে জানতে পারলাম যে এই পলায়নরত বাঙ্গালীদের উপর পাকিস্তান আর্মি নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। অসংখ্য লোক মারা গিয়েছে। তার নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা আমি বলতে পারবনা। এরপর আমাদের তো হাতে কোনো কাজ নেই।

ঐ বয়সী ছেলেরা তো ঘরে বসে থাকেনা। আমরা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের ভিতরে একটা পুকুর ছিলো, সেখানে গিয়ে মাছ ধরতাম। এভাবেই আমাদের দিনগুলো পার হয়ে যেতে লাগলো।

এরপর ১৭ই এপ্রিল আমাদের স্বাধীন বাংলা সরকার গঠিত হলো এবং জয়বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার শুনতে পেলাম।

অনেক ভেবেচিন্তে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করব। কিন্তু আমরা আমাদের ঐ বয়সে ফরিদপুর, কুষ্টিয়া বা মেহেরপুর ঐ এলাকাগুলোতে কখনো যাইনি, কিভাবে যেতে হয় তাও আমরা জানিনা।

আমরা ম্যাপ দেখে দেখে মেহেরপুরের  আম্রকানন, যেখান থেকে আমাদের স্বাধীনতার প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছিল, সেখানে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না।

এখনকার মত এত আধুনিক ম্যাপ তখন ছিলনা। আমাদের কাছে ব্রিটিশ একটা এটলাস ছিলো। বাংলাদেশের একটা ডিটেইলড ম্যাপ পেলাম।

আমরা দেখলাম যে আমরা যদি কুমিল্লা দিয়ে ভারতে যাই, তাহলে এটা সহজ হবে। এইভাবে প্ল্যান করে আমরা ৭ জন বন্ধু বাড়িতে কিছু না বলে বেরিয়ে পরলাম।

আমি আমার বড় বোনকে বললাম যে, একজায়গায় লুটের কিছু শাড়ী কাপড় বিক্রি করতেছে, তুমি কিনবে নাকি? তখন একটা শাড়ীর দাম ১০—১৫ টাকা।

ওকে এগুলো বলে ওর কাছ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে আমরা সবাই একসাথে বেরিয়ে পরলাম। প্রথমে আমরা সদরঘাট গেলাম। ওখান থেকে আমরা লঞ্চে করে রামচন্দ্রপুর গেলাম। এটা ছিলো মুরাদনগর বা হোমনাতে।

রামচন্দ্রপুরে আমরা সন্ধ্যায় পৌছালাম। ওখানে পৌঁছে আমরা এলাকার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম ওপারে কিভাবে যাবো।

ওখানে এলাকার লোকজন আমাদেরকে রাতের বেলায় যেতে নিষেধ করে রাতটা ওনাদের কাছে কাটিয়ে ভোরবেলা চলে যেতে বললেন। তখনকার সময়ে গ্রামের কোন বাড়িতে একসাথে ৭ জনের খাবারের ব্যাবস্থা করা ছিলো খুবই কঠিন ব্যাপার।

আমরা যে ভদ্রলোকের বাড়িতে ছিলাম, উনি আমাদেরকে একটা গামলাতে করে প্রায় কেজি খানেকের বেশি মুড়ি আর এক টুকরো বড় খেজুরের গুড় দিলেন। আমরা ওটা খেয়েই রাতটা পার করে দিলাম।

ভোরবেলা ওনারাই আমাদের জাগিয়ে দিলেন। আমাদেরকে চা আর মুড়ি খেতে দিলেন। এরপর একটা রাস্তা দেখিয়ে দিলেন আর বললেন যে এই রাস্তা ধরে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে এগিয়ে যেতে। আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। লোকেরা আমাদের বিভিন্নভাবে জায়গা দেখিয়ে দিতে লাগলো।

হয়ত ওনারা যে পথটুকুকে ৩ মাইল বলল, প্র্যাক্টিকালি দেখাগেলো তা প্রায় ১৫ মাইল। এই করতে করতে আমরা সন্ধ্যা নাগাদ ত্রিপুরার কোনাবনে গিয়ে পৌছালাম।

ওখানে পৌঁছানোর পরে বি,এস,এফ আমাদেরকে এক জায়গায় জড় করে রাখলো। তার পরদিন বি,এস,এফ আমাদেরকে আমাদের কাগজপত্র সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলো।

আমাদের কাছে দেখানোর মত কোনো কাগজপত্র ছিলোনা। ওরা আমাদের কাছে অন্তত ছাত্রলীগের সদস্য পরিচয়পত্র দেখতে চাইলো। আমাদের কাছে তাও ছিলোনা।

তখন ওরা আমাদেরকে বলল যে, তোমাদের আমরা এখানে ঢুকতে দিতে পারিনা। এভাবে আমরা ওখানে ২দিন থাকলাম। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করতে পারলামনা।

আমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা আবার দেশে ফিরে যাই। যে পথে আমরা ওখানে গিয়েছিলাম, সেই পথ ধরেই আমরা আবার ফিরে আসলাম।

এবং দেশে ফিরে আসার পর আমাদের মাথা থেকে মুক্তিযুদ্ধের ভূত নেমে গেলো। আমরা অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই তো করতে পারলামনা।

এদিকে আস্তে আস্তে ঢাকা শহর স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। এপ্রিলের ২৬ কি ২৭ তারিখের দিকে আমরা দেশে ফিরে এসে সেই মাছ ধরার কাজে লেগে গেলাম।

আর রেডিওতে জয় বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিছু খবর শুনে দিন পার করতে লাগলাম। এভাবে মে মাসের মাঝামাঝি সময় অতিক্রম হবার পর আমার কাছে কিছু ছেলেপেলে দেখা করতে আসলো। তাদের উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করতে তারা বলল যে, আপনি তো ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন।

এ কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম যে এরা কি করে জানলো যে আমি ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম? এখন যদি এরা আমাকে পাকিস্তান আর্মির কাছে ধরিয়ে দেয়?

আমি উত্তর দিলাম, ভাই আমি তো ইন্ডিয়া যাইনি। আর আমার ইন্ডিয়া যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। আমরা হলাম মুসলিম লীগ। আমাদের বাপ—দাদারা সবাই মুসলিম লীগ করত। আমরা হচ্ছি পাকিস্তানের পক্ষের লোক। এগুলো বলে ওদেরকে বিদায় করে দিলাম।

ক’দিন পরে ঐ ছেলেগুলোর সাথে আমার এক বন্ধুও আমার সাথে দেখা করতে আসলো। আমার বন্ধু আমাকে বললো যে, দোস্ত, এরা সত্যি সত্যিই ইন্ডিয়া যেতে চায়। তখন আমি যেভাবে যেভাবে ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম, সেভাবে সেভাবে ওদেরকে একটা ধারনা দিতে লাগলাম।

এভাবে ৩০ মে ওরা এসে বলল যে, আগামীকাল ওরা ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করবে। ওদের সাথে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে আমারও ওদের সাথে যেতে ইচ্ছে যাগলো। এরপর আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম যে ওদের সাথে যাবো। আমাদের দলে মোট ১২ জন ছেলে ছিলাম। আমার এক বন্ধু ছিলো মিকি যার বড় ভাই ,

জিয়া ভাই, যিনি ক্র্যাকপ্লাটুনে ছিলেন। সেই মিকি আর আমি ২ জন আর ওদের থেকে ১০ জনের আসার কথা। তো আমরা সদরঘাটে গিয়ে দেখি ওদের থেকে মাত্র ২ জন আসছে, বাকি ৮ জনই আসেনি।

আমরা ২ জন, মোট ৪ জন। তো এই ৪ জনই আমরা লঞ্চে উঠলাম। মে মাসের ৩১ তারিখে কিন্তু আর্মি অলমোস্ট সব জায়গাতেই ডেপলয় হয়ে গিয়েছে।

যাই হোক, আমরা যে লঞ্চটাতে চললাম, সেই লঞ্চটা মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টিতে থামল। সেখানে থামার পরে দেখলাম যে এফএফ রেজিমেন্ট, ফ্রন্টিয়ার ফোর্স পাকিস্তানের দুই সদস্য লঞ্চটিতে উঠলো যাদেরকে আমরা পাঠান বলি। ওরা এসেই আমাদের এক এক জনকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করল "তুমি কি করো? তুমি কি করো?

" ততদিনে আমাদের প্রত্যেকের ঢাকা শহরের আইডেন্টিকার্ড তৈরি হয়ে গিয়েছে। যেমন আমার আইডি কার্ডে লেখা ছিল প্রম্নফ রিডার।

এটা প্রত্যেকে যে যেভাবে পারছে তৈরি করে নিয়েছে। যেহেতু আমি পুরান ঢাকার ছেলে ছিলাম, আমাদের পুরান ঢাকার মানুষজন কিছুটা উর্দু ভাষায় কথা বলে।

সেই সুবাদে আমি কিছু উর্দু বলতে পারতাম কিংবা বুঝতে পারতাম। তখন সেই দু'জন পাকিস্তানি সোলজার আমাকে জিজ্ঞেস করল, "এ কোচে, তু কেয়া কারতা হায়?" তো আমি জবাবে বললাম “মে নক্রি করতাহুঁ।

“ জিজ্ঞেস করল, কিধার? আমি বললাম মৌলভীবাজার মে। আবার জিজ্ঞেস করল কেয়া নকড়ি? আমি বললাম প্রম্নফ রিডার। এটা বলার পরে সে আমাকে জিজ্ঞেস করল তুমি মৌলভীবাজারের খান সাব কে চেনো নাকি?

আমি বুঝতে পারছিলাম না যে সে কোন খান সাব সম্বন্ধে জানতে চাচ্ছিলো। তবে আমার জানামতে মৌলভীবাজারে ঢোকার মুখে দু’জন পাঠান ছিল যারা টোবাকো বিজনেস করত। তা ভাবলাম বলে দিই যা হবার হবে। বললাম হ্যাঁ চিনি। তখন জিজ্ঞেস করল ওলোগ কিয়া কারতে হে? আমি বললাম টোবাকো বিজনেস করে।

শুনে ও খুশি হয়ে গেলো। অর্থাৎ ওর সাথে মিলে গেল। এরপর ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করল তুমি কোথায় যাচ্ছ? তো আমি বললাম আমি নানা বাড়ি যাচ্ছি। আমার মা ওখানে আছে।

জবাবে জিজ্ঞেস করল কবে ফেরত যাবে? আমি বললাম সাতদিন পরে। এর পর ও বলল ঠিক আছে যাওয়ার সময় আমার সাথে সাক্ষাৎ করো এবং সালাম দিও। এরপর ওরা আমার পাশের বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল তুম কেয়া করতাহে? জবাবে আমার বন্ধুটা ভয় পেয়ে “আমি ছাত্র” বলে দিল। ওরা ছাত্র শব্দটা বুঝতে পারল না।

তাই ওরা উপস্থিত শিক্ষক কে  করল এই ছেলে কি করে? তখন শিক্ষক, স্টুডেন্ট বলে দিল। ছাত্র শুনেই ওরা খেপে গেলো। ওরা তো তখন আমার ঐ বন্ধুটাকে ধরে নিয়ে গুলি মেরে দিবে, মেরে ফেলবে, এই সমস্ত বলতে শুরু করল। আমি তখন ওদের পা ধরে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে ও খুব ভালো ছেলে। তো যাই হোক ওরা কিছু করলো না।

এর মধ্যে একটা কলা ওয়ালা আসলো, ওরা কলা ওয়ালার কাছ থেকে দুটো কলা ছিড়ে নিল, একটা আমাকে দিলো। আমি কলা খেলাম। তো ওরা আমাদের কিছু করলো না, খালি ছাত্র বলার কারণে ওই ছেলেটাকে একটা থাপ্পর দিল। তো যাহোক, আমরা লঞ্চ থেকে রামচন্দ্রপুর নামলাম। ওখানে নেমে একটা বাড়িতে থাকলাম।

পরের দিন আমরা ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ কলেজের সামনে দিয়ে একদম ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুমিল্লা মেইনরোড যেটা আছে, সেটাতে পাকিস্তানি আর্মিরা পেট্রোল দেয় ওখানে পৌছলাম। তাদের সাঁজোয়া গাড়িগুলোতে লং রেঞ্জ এর মেশিনগান লাগানো রয়েছে। তারা চাইলেই দূর থেকে ফায়ার করতে পারে।

যেহেতু আমরা গ্রামের ছেলে না শহরের ছেলে, গ্রামের ছেলেদের মত আমরা লুঙ্গি পরি না, প্যান্ট—শার্ট পরি। তাই সেখানকার চেয়ারম্যান আমাদেরকে সেই রাস্তায় যেতে নিষেধ করল।

বলল এখন যেওনা, এখন সেখানে বিপদ আছে। তখন দুপুর তিনটার মতো বাজে, আমরা চেয়ারম্যানের বাড়িতে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করলাম। সন্ধ্যার দিকে উনি আমাদেরকে একজন লোক সাথে দিলেন। তার সহযোগিতায় আমরা সেই রোড পার হয়ে গেলাম।

সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঢাকা চিটাগাং রেললাইন পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। রেললাইন পার হয়ে এক কিলোমিটার পরে হচ্ছে ইন্ডিয়া ত্রিপুরা। আমরা এবার সোনামুড়া দিয়ে ঢুকলাম। এবার ঢোকার সময় আমাদের তেমন কোন প্রবলেম হয়নি। ঢুকে গেলাম এবং সেখানে একটা ঘরে আমরা আশ্রয় নিলাম।

সেখান থেকে আমরা পরের দিন সকালে চান্দের গাড়ি করে আগরতলা গেলাম। সেটা ছিল জুনের ১ তারিখ। আগরতলা যাওয়ার পরে আমরা কংগ্রেস ভবনে গেলাম।

সেটা ছিল আগরতলা শহরে। ওখানে যাওয়ার পরে কয়েকজনের সাথে দেখা হল, ওরা আমাদেরকে একটা ইয়ুথ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিল। ইয়ুথ ক্যাম্প এ আমি সাত দিনের মত ছিলাম। ওখানে যাওয়ার পরে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এখানে কোন অস্ত্রসস্ত্র ট্রেনিং নেই।

ওখানে শুধু লেফট রাইট করায় আর জঙ্গলে গিয়ে লাকড়ি কাটতে হয় রান্নাবান্নার জন্য, যেটাকে ফেটিগ ডিউটি বলে। এভাবে সাতদিন করার পরে আমার কাছে মনে হল যে আমি এখানে আসছি কেন? তখন সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাদের যিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তার নাতি ওখানে ছিলেন।

উনি হয়তো আমার থেকে ৫—৬ বছরের বড় হবেন। উনি হয়তো কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন আমার ঠিক জানা ছিল না। উনি বললেন যে, উনি ক্যালকাটা যাবেন। আমি ওনার কাছে বললাম যে, আমাকে আপনি আপনার সাথে ক্যালকাটা নিয়ে যান। উনি রাজি হয়ে গেলেন।

তখন আমি আমার বন্ধুকে বললাম যে আমি কলকাতা যাচ্ছি, তুই যাবি কিনা। ও বলল যে, না কলকাতা যাবো না। কলকাতা কিভাবে যাব এত দূরে? আমি উনার সাথে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

ত্রিপুরা থেকে যে কলকাতা কতদূর, তা আপনারা ম্যাপ দেখলে বুঝতে পারবেন। ত্রিপুরার আগরতলা হলো আমাদের ম্যাপের পূর্বদিকে, আর কলকাতা হলো আমাদের ম্যাপের পশ্চিম দক্ষিণ কোণে। তার মানে পুরো বাংলাদেশ ঘুরে সেখানে যেতে হয়। আমরা আগরতলা থেকে বাসে করে ধর্মনগর গেলাম।

এটা ছিল খুবই পাহাড়ি রাস্তা। অনেক লোকজন বমি করতে লাগলো। ধর্মনগর থেকে আমরা ট্রেনে করে আসামের লামডিং গেলাম। লামডিং থেকে গুয়াহাটি গেলাম। গুয়াহাটি থেকে আমরা খেজুরিয়া মাঠ হয়ে ফারাক্কা ব্রিজ পার হয়ে চার দিন বসে কোলকাতা পৌছালাম। সেখানে পৌছে আমরা দুই বন্ধু গেলাম বাংলাদেশ মিশনে।

ততদিনে বাংলাদেশ হাইকমিশন যেটা পাকিস্তান হাইকমিশন ছিল, সেটা বাংলাদেশের পক্ষে চলে এসেছে। ওখানে যাওয়ার পরে আমাদেরকে বলল, তোমরা ফর্টি ফাইভ প্রিন্সেপ স্ট্রীট ধর্মতলা তে ডঃ বিধান চন্দ্র সেন (ওয়েস্টবেঙ্গলের একসময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন), উনার বাড়িতে যাও, ওখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সিলেকশন হয়। ওখানে গেলাম।

এখানে তিন চার তলার একটা বাড়ি। সেই বাড়িতে জয়বাংলা অফিস করা হয়েছে। ওখানে যাওয়ার পরে ঢাকার একটা ছেলের সাথে পরিচয় হলো।

সেই ছেলেটা আমাদেরকে বলল তুমি তাড়াতাড়ি একটা জায়গা দখল করে নাও, এখানেই আমাদেরকে থাকতে হবে। আমি তাড়াতাড়ি আমার কাছে একটা ব্যাগ ছিল, সেই ব্যাগটা রাখলাম, ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে বিছিয়ে দিলাম। ওখানে দুদিন অতিবাহিত হল।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এম,পি,এ (মেম্বার অফ দি প্রভিরিয়ান অ্যাসেম্বলী) জনাব নুর ইসলাম মঞ্জু, উনার সাথে দেখা। উনি আমাদেরকে বললেন, তোমরা ৯ নম্বর সেক্টরের তোকিপুরে চলে যাও। ওখান থেকে আমরা ৭—৮ জন ট্রেনে করে ২৪ পরগনার তোকিপুর ক্যাম্পে চলে গেলাম।

সেটা ছিল হাসনাবাদ থানার একটা ক্যাম্প। ওখানে যাওয়ার পরে আমরা দুই তিন দিন ছিলাম। তারপর সেখানে ভারতীয় আর্মিদের ট্রাক আসলো। তারপর সেই ট্রাকে উঠিয়ে আমাদেরকে একটা ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে গেল। ইন্ডিয়ান ট্রেনিং ক্যাম্প চাকুলিয়াতে। সেখানে একুশ দিন ট্রেনিং করে আমরা আবার তোকিপুর ক্যাম্পে ফেরত আসলাম।

ক্যাম্পে আসার পরে আমাদের প্রথম একটা অপারেশনে পাঠানো হলো। আমাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হলো যে, তোমরা বাংলাদেশের ভিতরে গিয়ে ছোটখাটো অপারেশন পরিচালনা করবে।

ছোটখাটো অপারেশন বলতে আর্মিদের কোন ছোটখাটো ট্রুপসের উপরে অতর্কিত আক্রমণ কিংবা মাইন বসিয়ে কোন ট্রাক ধ্বংস করা, বিভিন্ন জায়গার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা ইত্যাদি ইত্যাদি।

তো প্রথমবার আমরা সেরকম কোনো সুবিধা করতে পারলাম না। কারণ ওই এলাকাতে অনেক বাংলাদেশবিরোধী লোকজন ছিল এবং আমাদের মুভমেন্ট অনেক রেস্ট্রিক্টেড ছিল। সেই অপারেশনে আমরা কিছু টেলিফোনের তার বিচ্ছিন্ন করেছিলাম এবং কিছু গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলাম, এগুলো করেই ফিরে এসেছিলাম।

আমরা তেমন বেশি কোন ক্ষয়ক্ষতি করতে পারিনি, তখন মুক্তিযুদ্ধ কেবল ইনিশিয়াল স্টেজে ছিল। এই অপারেশনে আমাদের মেজর কোন সাকসেস আসেনি। যদিও আমরা যুদ্ধের মুডে ছিলাম কিন্তু কোন যুদ্ধ করতে পারিনি। অপারেশন শেষ করে এসে আমি তিন দিনের ছুটিতে কলকাতা গেলাম।

এবং আমার চাচা তখন কলকাতায় থাকতেন, তিনি ভারতীয় নাগরিক ছিলেন। আমার কাছে উনার ঠিকানা ভুল থাকার কারণে আমি ওনাকে প্রথমবার খুঁজে পাইনি। এইবার ছুটিতে গিয়ে আমি ভাবলাম যে আমি একটু আশেপাশে খুঁজি। খোঁজাখুঁজি করে আমি তার সাক্ষাৎ পেয়ে গেলাম।

আমার চাচা আমাকে পেয়ে বললেন, "কিসের মুক্তিযুদ্ধ? তুমি আর যেতে পারবে না, আমার এখানে থাকো, আমি তোমাকে স্কুলে ক্লাস টেনে ভর্তি করিয়ে দিব, তুমি আর যেতে পারবেনা। আমি তোমার বাবাকে কি জবাব দেবো?" উনি তো আমাকে ছাড়ছেন না, তাই আমিও ভাবলাম ঠিক আছে থাকিনা দু'একদিন।

এর পরের দিন আমি কলকাতা নিউমার্কেটে গেলাম। ভাবলাম যদি দু'একটা শাড়ি কাপড় কিনে নিয়ে যেতে পারি, যেহেতু আমি আমার বোনের কাছ থেকে মিথ্যে কথা বলে টাকা নিয়ে এসেছিলাম। শাড়ির দাম তখন খুব একটা বেশি না, ২০—২৫ টাকা।

তো কলকাতা নিউমার্কেটে হঠাৎ করে দুজন লোককে ঘুরতে দেখলাম যাদের মধ্যে একজনকে আমার খুব পরিচিত মনে হল, আমি তাদের পিছনে প্রায় আধাঘণ্টা ঘুরলাম। ঘোরার পরে আমি তাদের সামনে গিয়ে বললাম এক্সকিউজ মি, আপনি কি ডক্টর জাফরুল্লাহ চৌধুরী?

তিনি উত্তর দিলেন হ্যাঁ, তুমি কে? আমি বললাম আমি তোমার ছোট ভাই। তিনি বললেন তুমি এখানে কি করো? আমি বললাম, আমিতো মুক্তিযুদ্ধের জন্য এখানে আসছি। আমি এখন ছুটিতে চাচার বাসায় উঠেছি। আমার ভাই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং আমার সাথে আমার চাচার বাসায় গেলেন।

তিনি আমার চাচার সাথে দেখা করলেন, আমার চাচা বললেন, "ওকে তো ছাড়া যাবে না। কোথায় গিয়ে বেঘোরে প্রাণ দিবে।" আমার ভাই বললেন, "ঠিক আছে, দেখা যাবে।" আমার ভাইয়ের সাথে ছিলেন ডঃ মুবিন। ত্রিপুরার বিশামগঞ্জে একটা হাসপাতাল হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।

ওনারা দুজন মিলে ওই হাসপাতালটি তৈরি করেছিলেন। আমি আমার বড় ভাই এবং ডঃ মুবিন এর সাথে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে গেলাম যেখানে বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার।

উনারা আমাকে জেনারেল ওসমানী সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন। উনি তখন কর্নেল ওসমানী। আমার ভাই আমাকে উনার কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন যে, " " Sir, he is my youngest brother. He is loitering in Calcutta City. You should send him to a camp." ." কর্নেল ওসমানী আমাকে বললেন যে, "তোমার বাসা কোথায়?" আমি বললাম, ঢাকাতে। উনি বললেন, "তাহলে তো তুমি এখানে কিছু করতে পারবে না।

তোমাকে আমরা সেক্টর টু তে মেলাঘরে পাঠিয়ে দিবো, ওরা ঢাকায় অপারেশন করে।" সেই কথা মোতাবেক আমার ভাই আমাকে এবং ডঃ মুবিন কে প্লেনের দুটো টিকিট কেটে দিলেন।

প্লেনটি যাবে কলকাতা গুয়াহাটি হয়ে আগরতলা। বাংলাদেশের উপর দিয়ে ইন্ডিয়ান এয়ারক্রাফটের জন্য তখন নো ফ্লাই জোন ডিক্লেয়ার করে দেয়ার কারণে প্লেন চলতে পারে না।

আমি আর ডক্টর মুবিন আগরতলা এসে মেলাঘর ক্যাম্পে গেলাম যেটা সেক্টর টু হেডকোয়ার্টার, যেটা পরবর্তীতে K Force  হেডকোয়ার্টার হয়েছিল। ওখানে যাওয়ার পরে আমাদের ক্যাপ্টেন হায়দারের সাথে দেখা হল।

ক্যাপ্টেন হায়দার, মেজর মতিন এবং আরো ছিলেন লেফটেন্যান্ট মালেক তারপরে আরো অনেকের সাথে সাক্ষাৎ হলো। কর্নেল খালেদ মোশাররফের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে আমাদের সেখানে। আমরা ঐদিন একটা অফিসার্স মেস রয়েছে যেটা বেড়ার একটা ঘর ভিতরে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে চকি বানানো, ওটা ছিল অফিসার্স মেস, ওখানে আমাদের রাতে থাকতে দিলো। ওদের সাথে আমরা রাতে খেলাম।

পরেরদিন আমাকে সুইমিংপ্লাটুন ট্রানস্ফার করে দিল। মেলাঘরের ওখানে ফরেস্টের একটা বাংলো ঘর ছিল, ওইখানে আমাদের সুইমিং প্লাটুনের লোকেশন ছিল, আর ঢাকা কোম্পানি, নোয়াখালী কোম্পানি, অন্যান্যরা ওরা তাঁবুতে থাকতো।

আমি সুইমিং প্লাটুনে যোগ দেওয়ার পরে আমাদেরকে প্রচুর ট্রেনিং দিতে শুরু করলো। ওখানকার প্রথম ট্রেনিং ছিল, মেলাঘরের কাছে একটা লেক আছে, ওখানে একটা রাজার বাড়ি আছে, সেই লেকে প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ কিলো সুইমিং করতে হতো।

এছাড়াও আমরা এক্সপ্লোসিভ এর উপরে ট্রেনিং করতাম যেমন বিভিন্ন এক্সপ্লোসিভ কিভাবে চার্জ করতে হয়, একটা ব্রিজ কিভাবে উড়িয়ে দিতে হবে, মাইন কিভাবে উড়িয়ে দিতে হবে।

যেমন এন্টি ট্যাংক মাইন, এম সিক্সটিন মাইন, এম ফর্টিন মাইন, এন্টি পার্সোনাল, প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, কর্ডেক্স, ডেটোনেটর সমস্ত ডিটেলস জিনিসের উপর ট্রেনিং হত।

তারপরে স্মল আর্মসের উপরে। এসএলআর, স্টেনগান এগুলোর উপরে ট্রেনিং হলো। এবং আমি যখন মেলাঘরে আসলাম তখন জুলাই মাস।

আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আমার ট্রেনিং হলো। এরপর আমাদেরকে অপারেশনে পাঠাবে। আমি আমার অথরিটিকে বললাম যে, অনেকদিন দেশে যাই না, একটু দেশে যেতে চাই। তখন সিদ্ধান্ত হল যে, দাউদকান্দিতে একটা অপারেশন করবো, অপারেশন শেষ করে আমরা ঢাকাতে যাব।

বিশে আগস্ট এর দিকে ক্যাপ্টেন হায়দার, বর্তমানে কর্নেল শহীদ হায়দার, উনি আমাদেরকে বললেন, "ঢাকা দাউদকান্দি রোড টাকে আমরা অকেজো করে দিতে চাই।" কারণ হিসেবে তিনি আমাদেরকে বললেন দাউদকান্দি থেকে ঢাকায় আসার পথে তখন কোন ব্রীজ ছিল না।

দাউদকান্দিতেও কোন ব্রীজ ছিল না, বর্তমান মেঘনাতেও কোনো ব্রীজ ছিল না। এই দুটো জায়গাতে পাকিস্তান আর্মি ফেরি ব্যবহার করত। আমাদেরকে বলা হলো যে এই রাস্তাটা যদি আমরা অকেজো করে দিতে পারি, তাহলে আমাদের লাভ যেটা হবে, এদেরকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে শীপে মুভমেন্ট করতে হবে।

তাহলে সেটা ওদের জন্য অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের টার্গেট দেয়া হলো যে ভাটিয়ারচর ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে হবে এবং তার পরে কয়েকটা কালভার্ট উড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে তাদের জন্য এই রাস্তাটা মোটামুটি অকেজো হয়ে যাবে। যাহোক, পরিকল্পনা মোতাবেক আমরা প্রথমে ভাটিয়ারচর ব্রীজটি উড়িয়ে দিতে যাই।

আমরা ভাটিয়ারচর ব্রীজের চারটা পিলারে কাটিং চার্জ লাগাই এবং বিষ কেজি করে এক্সপ্লোসিভ লাগাই এবং কর্ডেট দিয়ে দূরে ডেটনেটর দিয়ে ইলেকট্রিক ব্যাটারির মাধ্যমে এই ব্রীজটাকে উড়িয়ে দেই। সেই অপারেশন শেষ করে আমরা চলে আসি। এরপর আমরা সেকেন্ড যে অপারেশনে যাচ্ছি, সেখানে ফোকাস করব আমি।

আমাদেরকে বলা হল যে ভাটিয়ারচর ব্রীজটা উড়িয়ে দেয়ার পর ওরা ফেরী চালু করে দিয়েছে। পারপজটা আমাদের কিন্তু পুরোপুরি সার্ভ হয়নি।

এবার আমাদেরকে একটা ডিটেইল প্ল্যান করে যেতে বলা হলো। বেশকিছুদিন থাকার প্ল্যান করে যেতে হবে। তখন আমাদের কমান্ডার ছিলেন রফিক ভাই। উনি গজারিয়ার। পরবর্তীতে উনি এই অপারেশনের কারণে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন। আমরা প্রায় বিষ জনের মত গেলাম।

আমার সাথে জাকির ভাই, চাঁদপুরের কালাম, আরও অনেকে ছিল যাদের নাম এখন স্মরণ নেই। এই অপারেশনটার জন্য আমাদের টার্গেট ছিলো আমরা ফেরীটা উড়াবো, তারপর ভবেরচর, বাউষ্যার ঐ সাইডের মোট ৪ টা কালভার্ট উড়াবো। যাতেকরে আর্মি যেন কোনো অবস্থাতেই এই রাস্তাটা আর ব্যাবহার করতে না পারে।

২৭ তারিখের দিকে ভারত থেকে আমাদের টীম নিয়ে আমরা চলে যাই। টীম নিয়ে আমরা একটা হাইড আউটে থাকি। হাইড আউট থেকে আমরা একটা নৌকা নিয়ে ফেরীটাকে উড়ানোর প্ল্যান করি। এর আগে আমাদের একটা রেকি টীম গিয়ে দেখে আসে যে ফেরীটা ঐ পারে থাকে অর্থাৎ ঢাকার সাইডে।

ওখানে বাঁধা থাকে এবং কিছু আনসার রাজাকার ফেরীগুলোকে পাহারা দেয়। আমরা যেটা লক্ষ্য করলাম যে সেই আনসার রাজাকাররা অতটা প্রশিক্ষিত নয়।

তাদেরকে রাইফেল ধরিয়ে দিয়ে ডিউটিতে রেখেছে মাত্র। প্ল্যান হলো, আমাদের একটা টীম আগে নামিয়ে দিবো যারা আগে গিয়ে আনসার রাজাকারদের নিউট্রালাইজ করবে।

এবং ফেরীর দুটো ইঞ্জিনে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে অকেজো করে দিতে পারলেই পুরো ফেরীই অকেজো হয়ে যাবে। সেই প্ল্যান মোতাবেক আমরা রাত ৩টার দিকে ফেরীটাকে উড়িয়ে দেই। আমরা ফেরীটাতে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে নদীর এইপারে চলে আসি। আমাদের তো পালিয়ে যেতে হবে।

ইলেকট্রিক ডেটনেটরের মাধ্যমে আমরা ফেরীটাকে উড়াই। আমরা দেখলাম যেন একটা আগুনের পিণ্ড আকাশে উড়ে গেছে, উড়ে এসে নদীর এইপারে পরেছে। এরপর ওখানথেকে আমরা হাইড আউটে আসি। তার পরেরদিন আবার আমরা রেকী পেট্রল করি দেখার জন্য। দেখি,না, ঐ এলাকায় আর রাজাকার বা অন্যকেউ নেই।

তার পরেরদিন এসে আমরা ভবেরচর এবং বাউষ্যার মোট চারটা কাল্ভার্টে কাটিং চার্জ দিয়ে চারটা কালভার্ট উড়িয়ে দেই। ঐদিন রাতের বেলা আমরা আর হাইড আউটে যাইনি। কারন আমরা ভেবে নিয়েছিলাম যে, ফেরী উড়ে গিয়েছে, কাল্ভার্ট নেই, আমাদের মনে হচ্ছিল যে এদিকে আর কেউ আসবেনা।

আমরা অনেক কনফিডেন্ট ছিলাম। ঐ রাতে আমরা রাস্তার পাশে একটা বাড়িতে ছিলাম। সকাল ৮টার দিকে নাস্তা খেয়ে আমাদের মাঝে ঐ অপারেশন নিয়ে ব্রিফিং হচ্ছিল। আমাদের মাঝে কেউ একজন বলল যে, আমরা যেখানে অপারেশনে গিয়েছিলাম, সেখানে তো আমরা এন্টি পার্সোনাল মাইন লাগিয়ে আসছি।

এন্টি পার্সোনাল মাইন হলো দুইপাশে দুইটা মাইন মাঝে একটা ওয়্যার দিয়ে কানেক্ট করা। তারটা ছদ্মবেশী, তাই দেখা যায়না।

তারের সাথে লাগলেই মাইনটা এক্সপ্লোড করবে। তো আমাদের মাঝে আলোচনা হলো যে এ মাইনগুলোতে আর্মিও মারা যাবেনা, রাজাকারও মারা যাবেনা। মারা যাবে আমাদের গ্রামের সাধারন মানুষ। তাই আমাদের মাঝে সিদ্ধান্ত হলো যে এই মাইনগুলোকে আমরা ডিজার্মড করবো। আমরা ওখানে ৮ জনকে পাঠালাম।

সেই ৮ জনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও ৫—৬ জনকে পাঠানো হলো গ্রামের মধ্যে পেট্রলিং করতে, যাতে গ্রামে আর্মি বা রাজাকার থাকলে সতর্ক করতে পারে। আর আমরা ৪ জন রাস্তার পাশে পাহারা দিচ্ছি। আমি আর কালাম রাস্তার এই পাশে একটা খড়ের গাদার আড়ালে বশে আছি।

আমাদের কখনই মনে হয়নি যে আর্মি বা মিলিশিয়া আসতে পারে। একদম নির্ভয়ে ছিলাম আমরা। প্রায় বারোটার দিকে হঠাৎ করে আমরা রাস্তা দিয়ে বুটের আওয়াজ পেলাম। আমরা খুব ঘাবড়ে গেলাম যে কি হচ্ছে এটা! আমরা আড়াল থেকে দেখলাম যে ১৫—২০ জন লোক খাকি পোশাক পড়া অস্ত্র হাতে এদিকে আসতেছে।

আমি কালামের দিকে তাকিয়ে আছি। কি করা উচিৎ এখন? আমি যেন এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, ওদেরকে দেখে মনে হলো যেন আমার আত্মাটা উড়ে গেলো।

হতবিহ্বল হয়ে গেলাম আমরা। আমি ভয়ে কাঁপছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন আজ আমার জীবনের শেষ দিন। একটুপরেই আওয়াজ পেলাম, “বাড়ীওয়ালা, এ বাড়ীওয়ালা। বাড়ীওয়ালা, এ বাড়ীওয়ালা। তখন কিন্তু আমি ভয়ে প্রায় প্রস্রাব করে দেয়ার মত অবস্থা।

তারা হয়ত আমাদের থেকে খুব বেশি হলে ১০—১৫ গজ দূরে ছিলো। কালাম আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “গুলি চালা। আমি চোখ বন্ধ করেই মোটামুটি আমার স্টেনগান থেকে এলোপাতারি গুলি ছুঁড়তে শুরু করলাম।

কাকে মারলাম, কোথায় মারলাম, আমার কোনো কিছু খেয়াল নেই, শুধু মাত্র ফায়ার করে আমার ম্যাগাজিন খালি করে দিলাম। এরপরই শুনতে পেলাম আশেপাশের জায়গা থেকে “জয় বাংলা স্লোগান আসছে।

লোকজনের আওয়াজ। আমি তখনও বুঝতে পারছিলামনা যে কি হইছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনতে পাচ্ছিলাম কিছু কিছু বুটের আওয়াজ দূরে সরে যাচ্ছে।

তাড়াতাড়ি আমরা দাড়িয়ে দেখলাম যে ওখানে প্রায় ৮—১০ জন পাকিস্তানি আর্মি পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখতে পেলাম যে তারা পাকিস্তানি আর্মি না, তারা হলো মিলিশিয়া। ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস। ওদের জামার কলারে লিখা রয়েছে।

ওদের সাথে আবার কয়েকজন বাঙ্গালিও ছিলো। এরমধ্যে আমার কমান্ডার চলে আসলো। গ্রামবাসী তো ওদের পিটিয়ে মেরে ফেলতে চাইলো কিন্তু আমার কমান্ডার বলল যে, খবরদার! কারও গায়ে হাত দেয়া যাবেনা। কারন আমাদেরকে বলা হয়েছিলো যে, প্রীজনার্স অফ ওয়ার বা যুদ্ধবন্দী আমাদের জন্য খুবই মূল্যবান।

আপনি দেখবেন যে, ইসরাইলী ১ জন সেনার বদলে ওরা ১১০০ ফিলিস্তিনিকে ছেড়ে দেয়। তো ওখানে আমরা ৬ জনকে ইঞ্জিউরড পেলাম। আর বাকি ৫—৬ জন মারা গিয়েছে। তো আমরা তাড়াতাড়ি গ্রামের লোকজনকে নিয়ে ঐ মৃতদের কবর দিয়ে দিলাম। আর বাকি আহতদের নিয়ে আমরা ইন্ডিয়া চলে আসলাম।

এখানে বেশি সময় নষ্ট করা যাবেনা কারন পাকিস্তান আর্মি স্পীডবোট বা হেলিকপ্টারে করে চলে আসতে পারে। ওদের মাঝে লোকালি একজন ডাক্তার পাওয়া গিয়েছিলো, তার মাধ্যমে ফাষ্টএইড দিয়ে  ব্যান্ডেজ কমপ্লিট করে তাড়াতাড়ি আমরা ইন্ডিয়াতে নিয়ে যাই। আর আমি ওখান থেকে, যেহেতু আমার ছুটি, আমি লঞ্চে করে সদরঘাট চলে আসলাম।

খুব সম্ভবত সেটা ২রা সেপ্টেম্বর ছিলো। সদরঘাটে পৌঁছাবার পর আমার মনে হচ্ছিলো যেন সবাই আমাকে ফলো করছে। এই বোধহয় আমাকে ধরে ফেলবে। একটা রিক্সা নিলাম।

সদরঘাট থেকে রিক্সায় করে চকবাজার হয়ে বকশীবাজার আমার বাসায় গেলাম। তখন আমার মনে হলো, আমরা কিসের জন্য যুদ্ধ করতেছি? সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ আমার কাছে ঢাকা শহর মনে হয়েছে সম্পূর্ন স্বাভাবিক। দোকানপাট খোলা, বাজার খোলা, সবকিছু খোলা।

আমার বন্ধুরা এস,এস,সি পরীক্ষার্থী। সবাই পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টও পেয়ে গেছে। কিন্তু আমিতো পরীক্ষা দেইনি। আমাদের কি হবে? আমাদের ভবিষ্যৎ কি?

খুবই হতাশ হয়ে গেলাম। বাসায় আসলাম। আসার পর, আমার কাজের ছেলে আমাকে চিনতে পারেনা, আমার চুল বড় হয়ে গিয়েছিলো। চেহারার পরিবর্তন হয়েগেছে, কালো হয়ে গেছি। ঘরের বাইরে কোথাও যাইনা। এরমধ্যে আমার বড়ভাই একরামুল্লাহ চৌধুরীও চাচাতো ভাই শওকত আলী চৌধুরী কাঞ্চন, যার বাবা কলকাতাতে থাকতেন, ওনারা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কবে যাবে?

” আমি বললাম যে, আমাকে তো ৭ দিনের ছুটি দিছে। ওনারা বললেন, “আমরাও তোমার সাথে যাবো।” পরিকল্পনা হলো। আমি আর এবার ঘর থেকেই বের হইনি। কারন কোথায় ওদের গুপ্তচর আছে, কে জানে? তো ওনারা আমার সাথে রওয়ানা দিলেন। এবার আমরা নরসিংদী দিয়ে ত্রিপুরার সোনামুড়া এলাকা দিয়ে ভারতে যাই।

এবং ওখানথেকে আমি ওনাদের নিয়ে মেরাঘর ক্যাম্পে আসি। এসে আমার ক্যাম্পের যিনি ইনচার্জ, ওনাদের সাথে কথা বললেন। আমার ভাইয়েরা বললেন যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধে যেতে চাই, কিন্তু এখুনই নয়। আগে আমরা একটু কলকাতা থেকে ঘুরে আসি। আমার ভাই আর ওরা চলে গেলো কলকাতায়। ওনারা অক্টোবরের দিকে আমার ক্যাম্পে আসলেন।

এসেই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংএ অংশগ্রহণ করলেন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ওনাদের ট্রেনিং শেষ। এরমধ্যে মোটামুটি যুদ্ধের ইন্টেন্সিটি বাড়তেছে। আমার খবর পেলাম যে, ইন্ডিয়ানরাও এটাকে দ্রুত শেষ করতে চাচ্ছে। এবং আমাদের রেগুলার যে বাহিনী ছিলো, তারাও অনেক ইকুয়িপড হয়েছেন।

আমরা একটা গ্রুপ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা দেশের ভিতরে চলে গেছে। অল্পকিছু লোক যারা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিলেন, তাদের নিয়ে একটা গ্রুপ করা হলো। আমাদের গ্রুপে প্রায় ১৪—১৫ জন পাওয়া গেলো যারা ঢাকা শহরের। এবং আমার কাঞ্চন ভাই যেহেতু উনি ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলেন, ওনাকে লিডার বানানো হলো।

কাঞ্চন গ্রুপ নাম দিয়ে আমাদের গ্রুপ হলো। আমাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হলো যে আমরা ঢাকা শহরে ঢুকবনা। শহরের বাইরে থেকে পাকিস্তান আর্মি যাতে শহরের ভেতরে ঢুকতে না পারে, সেদিকে বাঁধা সৃষ্টি করবো।

এভাবে প্ল্যান করে নভেম্বরের সেকেন্ড উইকের মধ্যেই আমরা বাংলাদেশে পৌঁছে গেলাম। নবাবগঞ্জের পাড়া গ্রামে আমরা মুক্তিযোদ্ধা টিম নিয়ে আসলাম। ওইখানে আরেকটা গ্রুপ ছিল, মোশাররফ গ্রুপ।

উনারা প্রায় ৩০ জনের অধিক সদস্য নিয়ে অনেক বড় একটা গ্রুপ। ওই গ্রুপের কমান্ডার মোশাররফ ভাই, উনি বুয়েটের মেকানিক্যালের থার্ড কিংবা ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট ছিলেন।

উনার সাথে উনার আরো দুই ভাই ছিল। এক ভাই ছিল মোয়াজ্জেম, সে ঢাকা কলেজে পড়তো। আর তার ছোট ভাই ছিল মনির সে আমার সাথে এসএসসি এক্সামিনী, ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়তো।

তাদের বাবা ছিল পুলিশের এসপি। তখন ওইখানে পাড়া গ্রামে থাকা অবস্থায় মোশাররফ ভাই আমাদের গ্রুপ লিডার কাঞ্চন ভাই কে বললেন, "কাঞ্চন ভাই, যেহেতু আপনারা গ্রুপ ছোট, ছোট ছোট গ্রুপের উপরে হামলা হয়।

আপনাদের উপরে যদি হামলা হয়, তাহলে আপনারা কি করবেন? ভালো হয় যদি আপনারা আমাদের গ্রুপে যোগ দেন। তাহলে আমরা একটা বড় গ্রুপ হয়ে যাব, আমাদের শক্তিও বেড়ে যাবে।" কথামত আমরা মোশারফ গ্রুপে যোগ দিলাম। এবং ডিসেম্বরের ফাস্ট উইক পর্যন্ত আমরা পাড়া গ্রামে ছিলাম।

ওখানেই আমরা পেট্রোলিং করেছি। ওখানে তেমন আর্মি ছিল না। এরপর ইন্ডিয়ান আর্মি যখন যুদ্ধ ডিক্লেয়ার করে, তখন আমরা ওখান থেকে মোহাম্মদপুরের উল্টো দিকে বসিলা, ওখানে আমরা এসে ক্যাম্প করি।

এখন আমরা সম্মুখ যুদ্ধের যে টেকনিক, সেটা অনেকটা রপ্ত করে নিয়েছি এবং আমাদেরকে বলা হয়েছে যে গেরিলা আক্রমণ থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। এজন্যে আমরা ওই এলাকাতে ফিজিক্যাল বাঙ্কার করি। আমাদের হাতে যে এসএমজি বা এলএমজি ছিল, সেগুলো দিয়ে আমরা এলাকায় পাহারা বসিয়েছি।

বং আমরা কিছু জায়গায় এন্টি পার্সোনাল মাইন বসিয়েছি যাতে করে আমাদের কাছে কেউ না আসতে পারে। পিছনের দিকে আমরা দুইটা পোস্ট করি যাতে পিছন দিক থেকে কোন আর্মি পালিয়ে এসে আমাদেরকে আক্রমণ করে, তাহলে তো আমরা ধরা পড়ে যাব।

সে ভাবে আমরা একটা বক্স করে যেটাকে একটা বক্স ডিফেন্স সিস্টেম বলা যায়, এরকম করে আমরা আছি। ডিসেম্বরের ১৩ থেকে ১৪ তারিখের দিকে আমরা পাকিস্তানি একজন লেফটেনেন্ট সহ দশজনকে অ্যারেস্ট করি।

সেই লেফটেন্যান্ট এর নাম ছিল আফতাব বালুচ, আমার যতটুকু মনে পড়ে। যেহেতু আমাদের কাছে যুদ্ধবন্দী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই তাদেরকে অ্যারেস্ট করে আমরা রেখে দিলাম।

এরপর ১৬ তারিখ বিকেল বেলা ঢাকা রেসকোর্স যেটা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

তখন আমাদের কাছে দিকনির্দেশনা আসলো আমরা যেন আজকে ঢাকা শহর ক্রস না করি। ১৬ তারিখ রাত ১২ টার আগে কোনো অবস্থাতেই যেন ঢাকা শহর ক্রস না করি। ১৬ তারিখ রাত দেড়টা থেকে দুইটার দিকে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা ঢাকা শহরে ঢুকে যাব।

সেখানে আমরা বড় বড় দুইটা নৌকা জোগাড় করলাম। একটা নৌকাই সেই দশজন যুদ্ধবন্দী সাথে চার পাঁচজন পাহারাদার রাখলাম, আরেকটা নৌকাতে আমরা সবাই উঠে গেছি এবং আমি যেহেতু সুইমিং প্লাটুনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলাম, আমিতো জানি যে পানির সাথে ব্যবহার কিভাবে করতে হয়। আমি আমার পিঠের হেভারসেকের ভিতরে আমার এ্যামোনিশন বেল্টটা রাখলাম।

এবং আমার অস্ত্রটা একটা চাদর দিয়ে ভালো করে গিট দিয়ে রেখেদিলাম। তো আমরা নদী পার হচ্ছি, মাঝ নদীতে আমাদের নৌকাটা হঠাৎ করে ডুবে গেল। কি কারণে ডুবে গেল বুঝতে পারলাম না, ওভারলোড এর কারণে হতে পারে। যাহোক আমি আমার অস্ত্রসস্ত্র নৌকাতে রেখে লাফ দিয়ে নেমে গেলাম।

পানিতে নামার পরে আমি দেখতে পেলাম কেউ কেউ আমার পা ধরে টানাটানি করছে, আমি লাথি মেরে ছাড়িয়ে কোনরকমে এপারে আসলাম।

তখন তো প্রচুর ঠান্ডা, শীতে জমে যাওয়ার মত অবস্থা। ভোরের দিকে যখন আলো ফুটলো তখন খুজতেছি কে আসলো কে আসতে পারল না। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।

খানিক পরে আমি আমার ভাইকে দেখতে পেলাম। এবং এর খানিক পরে আমরা দেখতে পেলাম যে আমাদের মাঝে ১১ জনের কোন খোঁজ নেই। কিন্তু কোন্ ১১ জন সেটা বলা যাচ্ছে না। তো যাহোক, এর ভিতরে কারা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিয়েছে আমি জানিনা। ফায়ার সার্ভিস আসলো।

আমি তাদেরকে স্যালুট করি যে ওই সময়টাতেও তারা অ্যাক্টিভ ছিলো। এরপর আশেপাশের লোকজন এসে প্রথমে ডুবে যাওয়া নৌকাটাকে উঠালো। নৌকাতে আমার চাচাতো ভাই শওকত আলী চৌধুরী কাঞ্চনের বডি পাওয়া গেছে। ওই নৌকাতে আমার অস্ত্র, আমার ব্যাগ সব কিছু পাওয়া গেছে। যেহেতু আমি আমার অস্ত্র ফিরে পেয়েছি, সেহেতু আমি আবার কনফিডেন্স ফিরে পেলাম।

তারপর দুপুর বারোটা নাগাদ অন্য সকল ডেডবডি গুলোকে উদ্ধার করা হলো। বাইরে ১০টা ডেডবডি পাওয়া গেছে, টোটাল ১১ জন। সেদিন আমাদের ১১ জন সহযোদ্ধা শহীদ হয়ে গেল।

কিন্তু আমাদের যে কমান্ডার মোশাররফ ভাই তার যে ছোট দুই ভাই, তারা কিন্তু ইস্ট পাকিস্তান জুনিয়র এবং সাব জুনিয়র সুইমিং চ্যাম্পিয়ন ছিল।

কষ্ট লাগে যারা সুইমিং চ্যাম্পিয়ন, তারাও কিন্তু মারা গেলো। আপনারা যদি ঢাকার নতুন আজিমপুর কবরস্থানে যান, সেখানে গেট দিয়ে ঢোকার প্রথম হাতের ডানে তাদের ৯ টা কবর আছে। শান্ত মরিয়ম ফাউন্ডেশনের শান্ত, সুন্দরবন কুরিয়ার এর মালিক, সে ঐ কবরগুলোকে বাঁধাই করে পাকা করে দিয়েছে।

আর একটা কবর হচ্ছে মুনীরের, তাকে পলাশীতে কবর দেয়া হয়েছিল। আর বাকি একটা লাশকে মৌচাকের মোড়ে কবর দেয়া হয়েছে।

এই হল ১১ জন। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে যখন সবাই আনন্দ করছিল, তখন আমরা আনন্দ করতে পারিনি। আরেকটা কথা আমি বলি, তা হল এখানে আমি অনেক কিছু বলতে পারিনি অনেক কিছু মিস করে গিয়েছি মনে না থাকার কারনে, আমরা যারা যুদ্ধ করতে গিয়েছিলাম, আমরা কিন্তু কোন কিছু পাওয়ার আশা করে যুদ্ধ করতে যাইনি।

কোন স্বার্থের জন্য যাইনি। যেহেতু আমরা চোখের সামনে দেখেছি আমাদের মা বোনদেরকে হত্যা করা হয়েছে, আমাদের ভোটের অধিকার, আমাদের শাসন করার অধিকার সবকিছু নিয়ে নিয়েছে। আমরা তাদের গোলাম হয়ে গিয়েছিলাম। এগুলোর বিরুদ্ধে যে একটা বিদ্রোহ, সেই ক্ষোভ থেকে যুদ্ধে গিয়েছিলাম।

কিন্তু আজকে আমরা দেখতে পাই দুই লক্ষ দশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। কিন্তু আমার যেটা মনে হয়, যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে তাদের সংখ্যা ৭০ থেকে ৮০ হাজারের বেশি হওয়ার কথা নয়।

আর যারা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা, যারা ডাক্তার ছিলেন, যারা গায়ক ছিলেন, যারা ফুটবলার ছিলেন, যারা অফিস চালিয়েছেন তাদের সংখ্যা হয়তো আরো ২০—৩০ হাজার হতে পারে, কিন্তু আমাদের অনেকেরই ভুলে, অনেকেরই লোভের কারণে আজকে এত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গিয়েছে। তবে আমি এখনো মনে করি যে এই সংখ্যাটা যাচাই করা প্রয়োজন।

সত্যি কথা। আমি যেমন কি একটা জিনিস বলতে চাই যে ১৯৭১ সালে দুইটা পরীক্ষা হয়েছিল, এসএসসি এবং এইচএসসি এবং আমার হিসাব মতে শতকরা ৮৫ ভাগ ছাত্র সেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল।

যারা অংশগ্রহণ করেছে তারা তো মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তাদের বাবার নামের সাথে মিলিয়ে নিন।

এখনতো কম্পিউটার সিস্টেম রয়েছে। ওগুলো ম্যাচ করা যায়। দেখেননা, একই নামে ১০—২০ টা পাওয়া যেতে পারে। তাহলে তো বুঝা যাবে, যারা ৭১ সালে পরীক্ষা দিয়েছে, তারা কেন মুক্তিযোদ্ধা হবে?

আমি একটা জিনিস বলতে চাই, এই দেশটা কিন্তু যদি কেউ বলে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন করেছে, এটা ঠিক না। আমরা সবাই মিলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিরা স্বাধীন করেছি। কারণ কিছু পাকিস্তানি লোক ছাড়া আর সবাই বাংলাদেশের পক্ষে ছিল।

যেমন এখন একটা কথা খুব চালু রয়েছে, “রাজাকার, রাজাকার।” আমি কিন্তু রাজাকার শব্দটা শুনলে খুব কষ্ট পাই না, কারণ এই রাজাকার কারা ছিল? এই রাজাকার আমার ভাইয়েরাই ছিলো।

কারণ পাকিস্তানি আর্মি লোকাল চেয়ারম্যান কে বলতো, তোমার দশটা ছেলে দিতে হবে। তাদেরকে দিয়েছেন, তারা অস্ত্র—রাইফেল দিয়ে সাতদিনের ট্রেনিং করেছে, মাসে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেতন পেতো।

তারা কি সবাই মানুষ মেরেছে? এই রাজাকাররাই তো আমাদেরকে রাস্তা দেখিয়েছে। রাজাকাররাই তো আমাদেরকে হেল্প করেছে। এই রাজাকাররাই তো  আমাদেরকে কুমিল্লা ব্রহ্মনবারিয়া রোড পার করিয়ে দিয়েছে। এরাতো মুক্তিযুদ্ধের জন্যই কাজ করেছে। সব রাজাকারেরা কি খারাপ নাকি? আমরা সবকিছু ঢালাও ভাবে বলি।

এটা ঠিক না। কারণ আমরা যদি বলি মুক্তিযোদ্ধা আর যারা ইন্ডিয়াতে গিয়েছে তারা এদেশ স্বাধীন করে ফেলেছে, এটা মিথ্যে কথা। এই যে আমার দেশের লোকজন যারা আমাদেরকে রাস্তা দেখিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, যারা আমাদেরকে পৌঁছে দিয়েছে, তারা যদি এটা না করতো,

আমরা জীবনে সাকসেসফুল হতে পারতাম না। আর আমি যেটা মনে করি,  আমাদের মেজরিটি মুক্তিযোদ্ধা হলো গ্রামের কৃষক শ্রমীক ছিল, গ্রামের ছাত্ররা ছিল, এদের অনেকেরই বর্তমানে অবস্থা খারাপ। তাদের সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে, তাদের চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে।

ঠিক আছে তাদেরকে ভাতা দেয়া হচ্ছে, কিন্তু কথা হলো সবারতো এটার প্রয়োজন নেই। যেমন আমার ব্যক্তিগতভাবে ভাতার কোন প্রয়োজন নাই।

আমি ভালো আছি। আমি যে কাজটা করি, আমার ঐ ভাতার টাকা দিয়ে আমি অন্য লোকদের সাহায্য করার চেষ্টা করি আর আমি যেটা মনে করি, এই মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতির প্রয়োজন রয়েছে। আপনি আমাদেরকে এমআইএস—এ নাম দিয়ে দিয়েছেন, সার্টিফিকেট দিয়েছেন,

ডিজিটাল সনদ দিবেন, অনেক কিছু করবেন কিন্তু আমি একজন ফ্রিডম ফাইটার, আমি যদি একটা কার্ড দেই, সেই নেমকার্ড দেখে আপনি কি বুঝতে পারবেন যে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা? আমি যদি বীর মুক্তিযোদ্ধা লিখি, এটা নিয়ে আপনার মনে সন্দেহ হতে পারে, এতো বীরমুক্তিযোদ্ধা নাও হতে পারে।

কিন্তু আমাদের এই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যদি একটা পদক দেওয়া হয়, যেমন শান্তিকালীন পদক পুলিশে রয়েছে, বিপিএম, পিপিএম, বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল, প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল, সেনাবাহিনীতে রয়েছে অনেক রকম শান্তিকালীন পদক রয়েছে। অপারেশনাল পদক রয়েছে, বীর প্রতীক, বীর বিক্রম, বীর উত্তম, বীর শ্রেষ্ঠ।

যেহেতু আমরা অপারেশন করেছি, আমাদেরকে যদি একটা পদক দেয়া হয়, একটা পদক তৈরি করতে কত টাকা খরচ? ১০০০ টাকাই লাগুক।

এবং আপনি যদি পদকটার নাম মুক্তিযোদ্ধা গৌরব পদক, বিজয় গৌরব পদক, এরকম বিভিন্ন নাম হতে পারে। একটা পদক দেন যেই পদকের এভ্রিভিয়েশন আমি নামের শেষে ব্যবহার করতে পারব।

তাহলে আমার কার্ডে যদি সেটা লেখা থাকে বা আমার নেমপ্লেটে যদি এটা লেখা থাকে, তাহলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে, ইনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।

এটা সরকার চাইলে করতে পারে, এটার জন্য সরকারের খুব বেশি টাকার প্রয়োজন নাই। বিশ—ত্রিশ কোটি টাকা হলেই হবে। আমি বলি না যে, আমাদেরকে সেই পদকের জন্য কোনো এক্সট্রা টাকা দেন। আপনি ভাতা তো দিচ্ছেন। সুতরাং কোনো এক্সট্রা টাকার দরকার নেই।

আপনি আমাদের একটা পদক দেন এবং যদি আপনি মনে করেন এই পদকটা দুই রকমের করতে পারেন, যারা সসস্ত্র সংগ্রাম করেছে তাদেরকে একরকমের দিতে পারেন,

আর যারা সহযোগী ছিল তাদেরকে আর একরকম পদক দিতে পারেন কিন্তু আমি জানি না এই সিস্টেমে আমরা এই দুই লক্ষ দশ হাজারের ভিতর সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা বা অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা, নন অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে কোনো ভাগ করা হয়েছে কিনা আমার জানা নাই।

সেটা করা উচিত। আর আমি নতুন প্রজন্মকে বলবো যে, তোমাদের বাবা, চাচা, দাদা, নানা, মামা, ফুফু যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, সেটা তোমাদের জন্য একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য, একটা নতুন ভবিষ্যতের জন্য, একটা নতুন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন।

তাদেরকে শ্রদ্ধা কর, তাদের কথা স্মরণ কর, কারণ আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক চমৎকৃত ঘটনা রয়েছে, অনেক সুন্দর ঘটনা রয়েছে, অনেক দুঃসাহসিক ঘটনা রয়েছে, সেগুলো যদি তারা পড়ে জানে, তাদেরকে সম্মান করে, তাহলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে।

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments
মাসুদুল করিম অরিয়ন - Oct 22, 2022, 5:31 PM - Add Reply

নতুন প্রজন্মের শিক্ষার উদ্দেশ্য যেন না হয় শুধুই অর্থ উপার্জন।
নতুন প্রজন্মকে দুর্নীতিমুক্ত দেশ প্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদেরকে শিক্ষা দিতে হবে ত্যাগ আর আদর্শের বীরত্বগাথা ইতিহাস, আর জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ ত্যাগ ও আদর্শ খুঁজে পাওয়া যাবে একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথার মাঝে। তাই আমাদের উচিত বাংলার সূর্য সৈনিক একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথার ইতিহাস সংরক্ষণ এবং তা নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরা যাতে তারা আদর্শ আত্মত্যাগের ইতিহাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদেরকে আদর্শবান, দুর্নীতিমুক্ত দেশ প্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
ভিজিট করুন
www.mssangsad.com
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রোফাইল ও ইতিহাস ভিত্তিক একমাত্র ওয়েবসাইট

You must be logged in to post a comment.

You must be logged in to post a comment.

Related Articles
Recent Articles